• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

বৃষ্টি হয়ে ঝরছে..

   ১১ জুলাই ২০২৫, ০৪:৩১ পি.এম.
কবি আল মাহমুদ। ছবি-সংগৃহীত

আল মাহমুদ

তিতাস পারের কবি আল মাহমুদ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। শুক্রবার (১১ জুলাই) সোনালী কাবিনখ্যাত কবির ৮৯তম জন্মদিন। ১৯৩৬ সালের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইলে জন্মগ্রহণ করেন আল মাহমুদ। আর কবিতা ও কথাসাহিত্যে ষোলকলা পূর্ণ করে ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।

চিরসবুজ কবির জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ঐতিহ্য আয়োজন করেছে ৩ দিনের ‘কবি আল মাহমুদ বইমেলা’। মেলায় দেয়া হচ্ছে আল মাহমুদ রচনাবলি ও তার অন্যান্য বইতে বিশেষ ছাড়। আজ বিকেল ৪টায় রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটে আল মাহমুদকে ঘিরে আলোচনা, স্মরণ ও আবৃত্তি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। শনিবার (১২ জুলাই) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) এমবিএ ভবনে বিকাল ৪টায় কবিতা, স্মৃতিচারণ ও আড্ডায় স্মরণ করা হবে কবিকে।

আধুনিক বাংলা কবিতায় দেশজ অনুষঙ্গ, লোকজ শব্দ, বিচূর্ণ প্রেম বা রাজনীতি– সবকিছু মিলিয়ে এক নিজস্ব কাব্যভাষা নির্মাণ করেছিলেন আল মাহমুদ। কবির জন্মতিথিতে অর্পণ করছি এই শ্রদ্ধাঞ্জলি—

‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ
দুপুরবেলার অক্ত,
বৃষ্টি নামে বৃষ্টি কোথায়
বরকতেরই রক্ত।
……………………
প্রভাতফেরি, প্রভাতফেরি
আমায় নেবে সঙ্গে,
বাংলা আমার বচন আমি
জন্মেছি এই বঙ্গে।’

‘একুশের কবিতা’। এই অমর সৃষ্টিকর্ম আমাদের শুধু ভাষা আন্দোলনের শহীদদের কথাই মনে করায় না, মনে করায় জুলাই আন্দোলনে নাম না জানা অজস্র তরুণের বলিদানকেও। তাদের বুক থেকে ঝরে পড়া রক্তও বৃষ্টির মতো কথা কয়। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ তখন হয়ে যায় একটি চেতনা। সেই চেতনা পাখা মেলে ওড়ে জুলাই কিংবা আগস্টের বাকরুদ্ধ আকাশে!

আল মাহমুদ রচিত ‘নোলক’ কবিতাটিও পাঠ্যপুস্তকের বদৌলতে অনেকেরই পড়া হয়েছে। শৈশবের সোনার স্মৃতির সঙ্গে একাকার হয়ে যায় কবিতাটি। হয়তো তার চেয়েও বেশি কিছু, যা আমাদের নস্টালজিক করে তোলে। আমরা নোলক খুঁজতে গিয়ে তখন মায়ের আঁচলের তলে মুখ লুকাই। পিঠ চাপড়ানো গানে আমাদের চোখে নেমে আসে রাজ্যের ঘুম। খেই হারিয়ে ফেলি। গন্তব্য কোথায়? তিতাস, রূপসা নাকি অলকানন্দা? নোলকের কয়েক ছত্র–

‘আমার মায়ের সোনার নোলক হারিয়ে গেল শেষে,
হেথায় খুঁজি হোথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।
……………………
বললো কেঁদে তিতাস নদী হরিণবেড়ের বাঁকে
শাদা পালক বকরা যেথায় পাখ ছাড়িয়ে থাকে।’

২০১৯ সালের যেদিন পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন কাবিনের কবি, সেদিন ছিল শুক্রবার। অথচ কি আশ্চর্য, এমন সোনালি শুক্রবারের রজনী শেষেই ধরাধাম থেকে তিনি বিদায় নিতে চেয়েছিলেন! প্রকৃতি তার ইচ্ছের সাইকেলে চড়েছে, শেষ প্যাডেলটাও ঘুরিয়েছে। প্রকৃতি সম্ভবত কবিদের কথা শুনতে পায়। কি নিঠুর সেই সাধ পোরা সম্ভাষণ, মিলিয়ে দেখি–

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রিশেষে শুভ শুক্রবারে
মৃত্যুর ফেরেস্তা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ;
অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে
ভালোমন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’

বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে সক্রিয় থেকে আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতাকে নতুন আঙ্গিকে দাঁড় করিয়েছেন। শব্দরাশি ও বাক্ভঙ্গিতে বিশেষভাবে সমৃদ্ধ করেছেন লোকজ ভাণ্ডার। শুধুমাত্র ‘সোনালী কাবিন’ লিখেই তিনি শিল্পের চূড়ায় অবস্থান করতে পারতেন। কিন্তু ‘লোক লোকান্তর’ স্রষ্টার কলমের খোঁচায় সাজিয়ে তুলেছেন শিমুলসভা। কবিতার পাশাপাশি কথাসাহিত্যেও সমান বিচরণ তার।

আল মাহমুদ একাধারে একজন কবি, ছড়াকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, গল্পকার, শিশুসাহিত্যিক ও সাংবাদিক। জীবনানন্দ দাশের পর এতো বড় কবি বাংলা সাহিত্যে এসেছিলেন কিনা, সেটা নিয়ে তর্ক হতে পারে। যুক্তির তুবড়ি দিয়ে বাহাস চলতে পারে, চলুক। আমরা বরং তার অমর সৃষ্টি ‘সোনালী কাবিন’-এর প্রথম সনেটটি পড়ি–

‘সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিনী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দু’টি,
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রুকুটি;
ভালোবাসা দাও যদি আমি দেব আমার চুম্ব্ন,
ছলনা জানি না বলে আর কোন ব্যবসা শিখিনি;
দেহ দিলে দেহ পাবে, দেহের অধিক মূলধন
আমার তো নেই সখি, যেই পণ্যে অলঙ্কার কিনি।
বিবসন হও যদি দেখতে পাবে আমাকে সরল
পৌরুষ আবৃত করে জলপাইর পাতাও থাকবে না;
তুমি যদি খাও তবে আমাকেও দিও সেই ফল
জ্ঞানে ও অজ্ঞানে দোঁহে পরস্পর হব চিরচেনা
পরাজিত নই নারী, পরাজিত হয়না কবিরা;
দারুণ আহত বটে আর্ত আজ শিরা-উপশিরা।’

ব্যক্তি আল মাহমুদ নিয়ে বিতর্ক কম ছিল না। জীবনের ছুটে চলা ট্রেন কখনও ভুল স্টেশনে থেমেছে। কখনও বগি ঠিক করতে কিছুটা বেশি সময় লেগেছে। তবু ট্রেন তার যাত্রায় ছুটেছে দিকচক্রবালে। তবু মাহমুদের পদ্য-গদ্য আবেশ ছড়িয়েছে পাঠকমনে। এক ফোঁটা ফুরসত রাখেননি তিনি পরিতাপের।

শারীরিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কবিরও কি মানবীয় ক্ষুদ্রতার সমাপ্তি ঘটে যায়? ব্যক্তি কবি যদি ক্ষুদ্রতার মাইলফলক পাড়ি দিতে নাও পারে, তবু তার সৃষ্ট কবিতার মহত্ত্ব হারায় কি? কবিতাকে ‘কবিতা’ হয়ে উঠতে গেলে ‘যদি-কিন্তু-তবে’র পথ না মাড়ালেও চলে। তখন এগুলো গুরুত্বহীন অনুঘটক হয়ে পড়ে।

আল মাহমুদের কবিতাও তেমন। সেগুলো কারও ধার না ধেরেই কবিতা হয়ে ওঠে। তার ‘পানকৌড়ির রক্ত’ দেখে গল্পপাঠকের সম্বিৎ ফেরে। সেগুলো তখন আর অন্য কোনো রাস্তা দিয়ে হাঁটে না। হাঁটার দরকার পড়ে না। আমরা মাহমুদে নন্দনতত্ত্বের যেমন দেখা পাই, তেমনি ফান্ডামেন্টাল আখরও অদেখা থাকে না।

যতো সমালোচনাই থাকুক, বাংলা সাহিত্য আল মাহমুদকে মনে রাখবে তার কাব্য প্রতিভার ক্ষমতাবলে। মাহমুদের পিপাসার্ত কবিতা হয়তো বৃষ্টি হয়ে ঝরবে। আজকের মতো কোনো মেঘলা মেদুর দিনে সিক্ত করবে তপ্ত মাটিকে। সেগুলো কালো অক্ষর থেকে হয়তো হয়ে যাবে পানকৌড়ির ডানা। অক্ষরগুলো শুভ্র হোক কিংবা কৃষ্ণ, আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবে তার অজর কবিতায়, অসামান্য গদ্যে।

লেখাটির ইতি টানছি তার কবিতা ‘প্রত্যাবর্তনের লজ্জা’ দিয়ে–

‘শেষ ট্রেন ধরবো বলে এক রকম ছুটতে ছুটতে স্টেশনে পৌঁছে দেখি
নীলবর্ণ আলোর সংকেত। হতাশার মতোন হঠাৎ
দারুণ হুইসেল দিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে।
যাদের সাথে শহরে যাবার কথা ছিল তাদের উৎকণ্ঠিত মুখ
জানালায় উবুড় হয়ে আমাকে দেখছে। হাত নেড়ে সান্ত্বনা দিচ্ছে।
আসার সময় আব্বা তাড়া দিয়েছিলেন, গোছাতে গোছাতেই
তোর সময় বয়ে যাবে, তুই আবার গাড়ি পাবি।
আম্মা বলছিলেন, আজ রাত না হয় বই নিয়েই বসে থাক
কত রাত তো অমনি থাকিস।
আমার ঘুম পেলো। এক নিঃস্বপ্ন নিদ্রায় আমি
নিহত হয়ে থাকলাম।
অথচ জাহানারা কোনদিন ট্রেন ফেল করে না। ফরহাদ
আধ ঘণ্টা আগেই স্টেশনে পৌঁছে যায়। লাইলী
মালপত্র তুলে দিয়ে আগেই চাকরকে টিকিট কিনতে পাঠায়। নাহার
কোথাও যাওয়ার কথা থাকলে আনন্দে ভাত পর্যন্ত খেতে পারে না।
আর আমি এঁদের ভাই
সাত মাইল হেঁটে শেষ রাতের গাড়ি হারিয়ে
এক অখ্যাত স্টেশনে কুয়াশায় কাঁপছি।
কুয়াশার শাদা পর্দা দোলাতে দোলাতে আবার আমি ঘরে ফিরবো।
শিশিরে আমার পাজামা ভিজে যাবে। চোখের পাতায়
শীতের বিন্দু জমতে জমতে নির্লজ্জের মতোন হঠাৎ
লাল সূর্য উঠে আসবে। পরাজিতের মতো আমার মুখের উপর রোদ
নামলে, সামনে দেখবো পরিচিত নদী। ছড়ানোছিটানো
ঘরবাড়ি, গ্রাম। জলার দিকে বকের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। তারপর
দারুণ ভয়ের মতো ভেসে উঠবে আমাদের আটচালা।
কলার ছোট বাগান।
দীর্ঘ পাতাগুলো না না করে কাঁপছে। বৈঠকখানা থেকে আব্বা
একবার আমাকে দেখে নিয়ে মুখ নিচু করে পড়তে থাকবেন,
ফাবি আইয়ে আলা ই-রাব্বিকুমা তুকাজ্বিবান…।
বাসি বাসন হাতে আম্মা আমাকে দেখে হেসেফেলবেন।
ভালোই হলো তোর ফিরে আসা। তুই না থাকলে
ঘরবাড়ি একেবারে কেমন শূন্য হয়ে যায়। হাত মুখ
ধুয়ে আয়। নাস্তা পাঠাই।
আর আমি মাকে জড়িয়ে ধরে আমার প্রত্যাবর্তনের লজ্জাকে
ঘষে ঘষে
তুলে ফেলবো।’

ভিওডি বাংলা/ এমপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে 'সংস্কৃতিপল্লী' হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে 'সংস্কৃতিপল্লী' হিসেবে গড়ে তোলার আহ্বান
কৃষ্ণচূড়ার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য্য আগুন লেগেছে প্রকৃতিতে
কৃষ্ণচূড়ার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য্য আগুন লেগেছে প্রকৃতিতে
শিল্পকলা একাডেমিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ
শিল্পকলা একাডেমিতে অযাচিত হস্তক্ষেপ