• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

ভারসাম্য হারাচ্ছে রাজশাহী মহানগর, জীবিকার খোঁজে শহরমুখী মানুষ

রাজশাহী ব্যুরো    ২৬ অক্টোবর ২০২৫, ০৩:১৯ পি.এম.
ছবি: ভিওডি বাংলা

রাজশাহী মহানগরীর আয়তন ৯৬ দশমিক ৭২ বর্গ কিলোমিটার। জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও আশেপাশের জেলা থেকে আসা মানুষের চাপ বাড়ছে প্রতিনিয়ত। গ্রামে কর্মসংস্থান হারিয়ে ব্যবসা বা কাজের উদ্দেশ্যে রাজশাহীতে আসছেন তারা। একসময় গ্রামে কৃষি কাজের সাথে জড়িত থাকলেও সময়ের সাথে সাথে কৃষি কাজের সংকট দেখা দেয়ায় তারা জীবিকার আশায় গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। এতে ছোট্ট নগরী রাজশাহী তার ভারসাম্য হারাচ্ছে।

গ্রামে দারিদ্র ও কর্মসংস্থানের অভাব সরাসরি তাদের জীবনযাত্রার ওপর প্রভাব ফেলছে, যার ফলস্বরুপ চলতি বছর ঋণগ্রস্থ হয়ে আত্মহত্যার ঘটনা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। এছাড়াও কয়েক বছর থেকে খরা, পানি সংকট ও কৃষি জমির সংকোচন হওয়ায় কৃষি খাতে কর্মসংস্থান কমেছে এবং উপজেলা পর্যায়ে কৃষি জমিতে পুকুর খননের ফলেও কৃষি জমি অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে।

২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক দুটি গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিগত পাঁচ দশকে ১৩ বার ব্যতিক্রমী খরায় আক্রান্ত হয়েছে। খরার কারণে এই অঞ্চলে অনাবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪৫ শতাংশে। উত্তরের জেলাগুলোতে সৃষ্ট তীব্র খরার জন্য শুধু বৃষ্টি দায়ী নয়, বরং এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির ঘাটতি, খাল ও নদীতে স্রোতের অভাব, উচ্চ জনসংখ্যা ঘনত্ব, বন উজাড় ইত্যাদি কারণও দায়ী। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এগুলো মূলত মানবসৃষ্ট কারণেই ঘটেছে। ফলে গ্রামঞ্চলে ব্যাপক হারে কমছে কৃষি ভিত্তিক কর্মসংস্থান।

২০২২ সালের একটি গবেষণা অনুসারে, রাজশাহীর কিছু অংশে প্রায় ৬৩ শতাংশ মানুষ কৃষিকাজ ছেড়ে অ-কৃষি পেশায় যুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র শ্রমশক্তি জরিপ ২০২৪ অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগে প্রায় ৩ লাখ ৫৭ হাজার বেকার রয়েছে। যার ভেতরে মহানগরীতেই অধিকাংশের বসবাস করেন বলে জানা যায়।
গ্রামীণ অর্থনীতিতে মন্দাভাব, দিনমজুরি কমে যাওয়া এবং কর্মসংস্থানের সংকটে পড়ে অনেকে শেষ ভরসা হিসেবে শহরে পাড়ি জমাচ্ছেন। এতে রাজশাহী নগরীতে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষের চাপ, কিন্তু শহরে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান এবং কল-কারখানা না থাকায় অনেকেই হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছেন। এতে শহরে আসা অধিকাংশ মানুষ অটোরিকশা চালক হিসেবে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করছেন। অদক্ষ চালক এবং ট্রাফিক আইন না মেনেই গ্যারেজ থেকে ভাড়ায় চালিত অটোরিকশার পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। নগরীতে অটোরিকশায় সিটি কর্পোরেশনের অনুমতি রয়েছে ১৬ হাজার, কিন্ত বাস্তবে রাজশাহী নগরীতে চলাচল রয়েছে ৬০ থেকে ৭০ হাজারের মত। এত সংখ্যক গাড়ি থাকায় অনেক চালক দৈনিক কিস্তি বা ভাড়ার টাকা তুলতেই হিমশিম খাচ্ছেন। এতে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের ভরণপোষণে হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
সরেজমিনে রাজশাহী নগরীতে আগত কয়েকজন ব্যাক্তির সাথে এই বিষয়ে কথা বললে, তারা জানান তাদের হতাশার কথা। পবা উপজেলার বড়গাছি ইউনিয়নের শিয়ালবেড় গ্রাম থেকে রাজশাহী নগরীতে অটোগাড়ি চালাতে এসেছেন সনি ইসলাম নামের এক যুবক। তার কাছে এই পেশা বেছে নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পেট চালানোর জন্য কিছু একটা তো করা লাগবে ভাই। আগে বাড়িতে জমিতে কাজ করতাম। কিন্তু এখন জমিতে এক সপ্তাহ কাজ থাকলে পরের সপ্তাহে আর কাজ থাকে না। তাই বাধ্য হয়ে অটো চালাচ্ছি।’

নগরীর সাহেববাজারে গোদাগাড়ী এলাকার মামুন রেজা নামের এক অটোরিকশা চালক বলেন, “গ্রামে কাজ নেই, কৃষি দিয়ে সংসার চলে না। তাই শহরে এসে অটোরিকশা চালাই। কিন্তু এখানে চালক বেশি, যাত্রী কম। সারা দিন ঘুরেও ঠিক মতো টাকা হয় না।”

অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, গ্রাম থেকে এভাবে অকারণে শহরমুখী মানুষের স্রোত শহরের অবকাঠামো, যানজট ও কর্মসংস্থানের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তারা মনে করেন, গ্রামে শিল্প-কারখানা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো না গেলে শহরের ওপর চাপ আরও বাড়বে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্টবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বলেন, ‘রাজশাহী নগরীতেই কর্মসংস্থানের বড় অভাব। এখানে যদি বাইরে থেকে কর্মসংস্থানের আশায় মানুষ আসে তাহলে একটি বড় জনগোষ্ঠীকে সামাল দিতে হিমশিম খেতে হবে। সেইজন্য যারা নগরীর দায়িত্বপ্রাপ্ত আছে তাদেরকে এখন থেকেই বিশেষ পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। এছাড়ও নদী কেন্দ্রিক যে পর্যটন এবং জেটি হবে সেটি যদি করতে পারে এবং বিভিন্ন কল-কারখানা সৃষ্টি হলে এই সমস্যগুলো সমাধান হবে বলে আমি মনে করি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) রাজশাহী জেলা সভাপতি সফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘একটি পরিচ্ছন্ন, আধুনিক, বাসযোগ্য, রাজশাহী নগরী গড়তে আগে আমাদের নাগরিকদের ভিতরে সচেতনতা জরুরি। এছাড়াও যারা নগর পরিকল্পনাবিদ আছেন তারা যদি একটি মাস্টারপ্লান হাতে নিয়ে কাজ করে তাহলে একটি গোছানো শহর হতে পারে। আমাদের শহরে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি সবার আগে জরুরী।

’স্থানীয় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, গ্রামে ক্ষুদ্র শিল্প, কৃষিভিত্তিক প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প এবং স্থানীয় উদ্যোক্তাদের সহায়তা দিলে মানুষ শহরমুখী হবে না। অন্যথায় রাজশাহীর মতো শহরগুলো অচিরেই বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের বড় চাপে পড়বে।


ভিওডি বাংলা/ এমএইচ


  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
রাজশাহীর ‘লাইফলাইন’ বারনই নদী এখন নর্দমা
রাজশাহীর ‘লাইফলাইন’ বারনই নদী এখন নর্দমা
শরীয়তপুরে অর্ধশতাধিক হাতবোমা ফাটিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ
শরীয়তপুরে অর্ধশতাধিক হাতবোমা ফাটিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষ
মাদারীপুরে গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ
মাদারীপুরে গৃহবধূকে শ্বাসরোধে হত্যার অভিযোগ