সুনামগঞ্জে হাওরে দায়সারা প্রকল্পে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ


সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
সুনামগঞ্জে হাওরের কান্দা কাটা গর্ত ভরাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নেওয়া প্রকল্প দায়সারা প্রকল্পে রূপ নিয়েছে। কৃষিবান্ধব এ প্রকল্পে মোটেও রক্ষা হয়নি হাওরের স্বার্থ। এরই মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময়সীমাও শেষ পর্যায়ে। নির্ধারিত সময়ের প্রায় দেড় বছরে কাজ হয়েছে নামমাত্র।
পাউবো’র প্রকল্প কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনের সঙ্গে সরেজমিনে বাস্তবতার কোনো মিল নেই। কৃষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে পাউবো ও ঠিকাদার উভয়ে বরাদ্দের কোটি কোটি টাকা লুটপাটে তৎপর রয়েছে - এমন অভিযোগ কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাদের।
একাধিক হাওরের গর্ত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে সেরকম বাস্তবতাই চোখে পড়েছে। তবে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ না জেনে, না বুঝে করা হচ্ছে বলে দাবি সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের(পাউবো)।
জামালগঞ্জের হালি, শনি ও মহালিয়া হাওরের প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের পাশাপাশি কৃষক ও হাওর আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাওরের গর্ত (বাঁধে মাটি নেওয়ার ফলে সৃষ্ট গর্ত) ভরাটে এ উদ্যোগ ইতিবাচক। তবে পাউবো ও ঠিকাদারের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এখন পর্যন্ত এ প্রকল্পের কাজ ২০ শতাংশও হয়নি। হাওর অভ্যন্তরে অসংখ্য গর্ত থাকার পরও কোনো গর্তই পুরোদস্তুর ভরাট করেনি ঠিকাদার। কিছু কিছু গর্তে খুবই সামান্য বালু ফেলা হয়েছে। আবার বেশিরভাগ গর্ত আগে যেরকম ছিল এখনও সে রকমই আছে। প্রায় দেড় বছর মেয়াদের এ প্রকল্পে সময় ক্ষেপণ ছাড়া কাজের কাজ কিছুই হয়নি। হাওরপাড়ের মানুষ এ কাজের ব্যাপারে তেমন কিছু জানেও না। প্রাক্কলন তৈরির আগে ও পরে পাউবো এ নিয়ে কৃষকের সাথে কথা বলার প্রয়োজনও মনে করেনি। গর্তে বিটবালু ফেলে না ফেলে অনেকটা চুপিসারে এ কাজের ইতি টানতে চাইছে সংশ্লিষ্টরা।
টেকসই বাঁধ, জীববৈচিত্র্য ও গোচারণ ভূমি রক্ষাসহ হাওরের নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখতে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। গর্ত এলাকা পরিদর্শনে গেলে এ প্রতিবেদকের কাছে হাওরের নিরাপত্তা ও কৃষকের ভাগ্য নিয়ে পরিহাস করা ছাড়া কিছুই মনে হয়নি।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, জরুরি বন্যা পুনঃনির্মাণ সহায়তা প্রকল্পের আওতায় জেলার দশটি হাওরে বরাদ্দ হয়েছে ১৪ কোটি ৫ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। এর মধ্যে জামালগঞ্জে ৩ কোটি ২১ লাখ ৩৭ হাজার, তাহিরপুরে ৩ কোটি ৯২ লাখ ৭৮ হাজার, বিশ্বম্ভরপুরে ১ কোটি ৬৯ লাখ ৮১ হাজার, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর মিলে ৫ কোটি ২১ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
এ প্রকল্পের কাজ পায় নেত্রকোণার অসীম সিংহ ও টাঙ্গাইলের গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ। প্রকল্পের সময়সীমা ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের ৩০ মে পর্যন্ত রয়েছে। সময় ফুরিয়ে গেলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ভিটবালু দিয়ে হাওরের পুরোনো গর্ত ভরাটের কথা উল্লেখ আছে অগ্রগতি প্রতিবেদনে।
এর মধ্যে পাউবো’র হিসাব অনুযায়ী জামালগঞ্জে ৫৫ ভাগ, তাহিরপুরে ৩৫ ভাগ, ধর্মপাশা-মধ্যনগরে ১৩ ভাগ এবং বিশ্বম্ভরপুরে ১৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এখন পর্যন্ত বিলের ১৫ ভাগ অর্থ ছাড় হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। সবকিছু মিলে কাগজপত্রে কাজের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি হয়েছে জামালগঞ্জে। কিন্তু জামালগঞ্জের হালি, শনি ও মহালিয়া হাওরের সরেজমিনের চিত্র বলছে সেখানে ২০ ভাগের বেশি কাজ হয়নি। স্থানীয় কৃষক ও হাওর সচেতন মানুষও পাউবো’র এমন কাণ্ডে ক্ষোভ জানিয়েছে।
মহালিয়া হাওরে মদনাকান্দি গ্রামের গরু চড়াতে আসা সুশীল দাস বলেন, ‘শুনছি গর্ত ভরাটের ডাক হইছে। যেডা ভরছে এইডা মনে করইন চার ভাগের এক ভাগ হইছে। যদি পুরাপুরি ভরাড হইত, তাহইলে হাওরে ঘাস হইলনে, গরু ঘাস খাইলনে, বান্ধের (বাঁধের) শক্তি থাকলনে, বাঁন ভাঙবার ভয় থাকলনানে, হাওর তল হইলনানে। এই ভরাডে হাওরের উপকার হওয়ার কথা। কিন্তু উপকার হইল কই? ’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, ‘কার্তিক মাসে দেখছি কিছু কিছু জায়গা ভরাট করতাছে। পরে দেখছি তারা ড্রেজার লইয়া গেছে গা। এরপরে গর্ত ভরবার লাগি আর ড্রেজার আনা হইছে না।’
বেহেলী ইউনিয়নের আছানপুর গ্রামের কৃষক ও ইউপি সদস্য মো. ইউছুফ মিয়া বলেন, হালি হাওরের হেরাকান্দি অংশে সামান্য মাটি ফেলা হয়েছে। কোন গর্তই পুরোপুরি ভরাট করা হয়নি। এতে করে হাওরবাসীর কোনো উপকার হবে না। যারা কাজ করেছে তারাই লাভবান হবে।
মহালিয়া হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি সিরাজুল হক তালুকদার বলেন, সর্ব সাকূল্যে মহালিয়া হাওরের গর্ত ২০ শতাংশ ভরাট হয়েছে। যে কাজ হয়েছে, তাতে হাওরের কোনো কাজে আসবে না। যে সময় ভরাটের কাজ শুরু হয়েছে, তখন জিজ্ঞেস করলে তারা জানিয়েছে হাওরের গর্ত সম্পূর্ণ ভরাট করা হবে। কিন্তু কাজ না করেই তারা সবকিছু নিয়ে চলে গেছে।
কাজের ভালো-মন্দ তদারকির জন্য কোনো টিমকে আসতে দেখেননি জানিয়ে বেহেলী ইউনিয়ন পরিষদের ইউপি সদস্য ও মদনাকান্দি গ্রামের কৃষক দেবাশীষ তালুকদার বলেন, ড্রেজিংয়ের পাইপ দিয়ে শুধু পানিই এসেছে বালু আসেনি। বালু না আসলে তো গর্ত ভরাট হবে না। শুধু লোকদেখানো কাজ হয়েছে। কোনো গর্তই ভরাট হয়নি। শুনেছি এ কাজ বাইরের এক কন্ট্রাক্টরের। তবে হরিপুরের ভজন তালুকদার এ কাজ তদারকি করছেন।
হাওর থেকে ফিরে জামালগঞ্জ উপজেলা হাওর বাঁচাও আন্দোলনের সাংগঠনিক সম্পাদক আলী আক্কাছ মুরাদ বলেন, গর্ত ভরাটে কোটি টাকার প্রকল্প হয়েছে। কিন্তু কাজ হয়েছে লাখ টাকার। অধিকাংশ গর্তে মাটিই পড়েনি। কিছু গর্তের দুই-এক জায়গায় সামান্য ভিটবালু ফেলা হয়েছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি আরও বলেন, দিনের পর দিন এভাবে আমাদের বোকা বানিয়ে ফায়দা লুটছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কোটি কোটি টাকার সরকারি প্রকল্পের বিপরীতে হাওরের কোনো উপকারই হচ্ছে না।
হাওর বাঁচাও আন্দোলন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, এসব প্রকল্প দেওয়া হয় মূলত লুটপাটের জন্য। এ ব্যাপারে হাওরপাড়ের মানুষের সঙ্গে কোনো কথাবার্তা নেই। হাওরে গর্ত ভরাটের যে প্রকল্প দেওয়া হয়েছে, স্থানীয় লোকজন তার কিছুই জানে না। কৃষকদের না জানিয়ে প্রকল্প নেওয়া মানে বরাদ্দ গিলে খাওয়ার পথ তৈরি করা। আর পাউবো তাই করে বেড়াচ্ছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, অনেক গর্তই ভরাট হয়েছে। বাকিগুলো করা হবে। হাওরে বিল-বাদাল আছে, বলা হচ্ছে মাছ মারা যাবে। কৃষকরা বলছেন জমির ফসল নষ্ট হবে। সে কারণে কাজ করা যাচ্ছে না। সময় যদিও শেষ পর্যায়ে, তবে সময় আরও বাড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, অনিয়ম-দুর্নীতির যে অভিযোগ সে ব্যাপারে অনেকেই অনেক কিছু জানে না। যতটুকু কাজ হয়েছে তার চেয়েও অনেক কম বিল দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৫ শতাংশ বিল ছাড় হয়েছে। তাহলে অনিয়ম ও দুর্নীতি কোথায় হলো?
এ ব্যাপারে সাব-কন্ট্রাক্টর (সহ-ঠিকাদার) ভজন তালুকদারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
ভিওডি বাংলা/ এমপি/ এমএইচ
কুড়িগ্রামে নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু
কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিঃ
কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলায় ফুলকুমার নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে …

মোবাইল ফোন চুরির সন্দেহে যুবকে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ; আটক ৩
পাবনা প্রতিনিধি
পাবনায় মোবাইল ফোন চুরি করার সন্দেহে রাসেল হোসেন (৩১) …

গোপালগঞ্জে ৪ যানবাহনের সংঘর্ষে পুলিশ সদস্যসহ নিহত ২
গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি:
গোপালগঞ্জে চার যানবাহনের সংঘর্ষে ট্রাফিক পুলিশের এক সদস্যসহ …
