ফাঁদে আটকাচ্ছে না প্রশস্ত চাকার অটোরিকশা


জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
রাজধানীর প্রধান সড়কগুলোতে রিকশা চলাচল আটকাতে সংযোগ সড়কে দুই ধরনের ফাঁদ পাতা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সহযোগিতায় এটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ। গত মাসের শেষ সপ্তাহে পরীক্ষামূলকভাবে রমনার বেইলি রোডে এবং কাকরাইলের ব্যাটারি গলিতে ফাঁদ বসানো হয়েছে। এসব ফাঁদে সরু চাকার রিকশা ও অটোরিকশা আটকা পড়লেও ফাঁক গলে বেরিয়ে যাচ্ছে প্রশস্ত চাকার রিকশাগুলো।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এভাবে ফাঁদ পেতে রিকশা চলাচল বন্ধের চেষ্টা সফল হবে না। আগে উল্টোপথে যানবাবহন চলাচল বন্ধের জন্যও পুলিশ ফাঁদ পেতেছিল, সেই চেষ্টাও সফল হয়নি। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে এর যন্ত্রাংশ আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ব্যাটারি গলিতে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রিকশা আটকানোর ফাঁদগুলোকে ঘিরে উৎসুক মানুষের ভিড়। এখানে পাতা ফাঁদে রিকশা আটকানোর পাশাপাশি একই সঙ্গে চাকাও ছিদ্র হয়ে যাবে। ফাঁদের ওপর দিয়ে রিকশা পার করতে গিয়ে থামকে দাঁড়াচ্ছেন চালকরা। ফাঁদ দেখে কিছু চালক রিকশা নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন, আবার অনেক চালক সাহস করে পার হতে গিয়ে আটকে যাচ্ছেন সরু চাকার কারণে। কেউ কেউ আবার এলোমেলো পার হয়ে আটকানো এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রশস্ত চাকার অটোরিকশাগুলো মোটরসাইকেল ও সিএনজির মতো অনায়াসে সেই ফাঁদ পেরিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন
ফাঁদ পেতেও অটোরিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “আমাদের দেশে প্রায় ৩০ ধরনের অটোরিকশা চলে। সেগুলোর কোনোটি সরু চাকা বা সাধারণ রিকাশার চাকার। কিন্তু কিছু কিছু রিকশায় আবার মোটরসাইকেলের মতো প্রশস্ত চাকা ব্যবহার করা হয়। একই ধরণের ফাঁদে সব রিকশা আটকাবে না সেটাই স্বাভাবিক।
তিনি বলেন, ফাঁদ পেতে রিকশা আটকানোর পক্ষেও নই আমি। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণের জন্য এর কাঠামোয় বিজ্ঞানভিত্তিক পরিবর্তন আনা জরুরি। একইসঙ্গে অটোরিকশা তৈরির যেসব যন্ত্রাংশ যেমন মোটর কিংবা ব্যাটারি, এগুলোর বেশিরভাগইতো বিদেশ থেকে আমদানি হয়। এসব যন্ত্রাংশ আমদানি বন্ধ করতে পারলে এমনিতেই অটোরিকশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হবে। এছাড়া আইনও কঠোর করতে হবে, যাতে কোনো রিকশাই প্রধান সড়কে চলাচল করতে না পারে। কেউ আইন ভঙ্গ করলে সাজা নিশ্চিত করতে হবে।
বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, অটোরিকশাগুলোর ব্রেকিং সিস্টেম ও কাঠামোগত দুর্বলতার সমস্যার সমাধান করে সেগুলোকে চলাচলের অনুমতি দেয়া উচিত। তবে কোনোভাবেই এসব রিকশা মহাসড়ক বা প্রধান সড়কে চলাচলের পক্ষে নই আমি। এসব রিকশা মহল্লার ভেতরের সড়কে, কিংবা পার্শ্ব সড়কে চলতেই পারে।
তিনি বলেন, অটোরিকশার মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয় পায়ে টানা রিকশার বডিতে মোটর লাগানো রিকশাগুলো। সাধারণ রিকশার পেছনের চাকার সঙ্গে একটি মোটর লাগানো হয়, আর যাত্রী সিটের নিচে থাকে ব্যাটারি। রিকশার হ্যান্ডেলের সঙ্গে যুক্ত একটি সুইচ। মোটর লাগিয়ে জোরে চালানোর সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে এসব রিকশায় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকে।
অধ্যাপক হাদিউজ্জামান জানান, সাইকেলে বা রিকশাতে আমরা যে ব্রেক দেখি তা হলো ‘ইউ’ ব্রেক। এই ব্রেকে চাকার দুই পাশে দুটি ব্রেক প্যাড থাকে, যা রিমকে চাপ দিয়ে গতি নিয়ন্ত্রণ করে। অটোরিকশার ক্ষেত্রে এই ব্রেকের কার্যকারিতা খুবই কম, ভেজা চাকায় এই ব্রেক খুবই কম কাজ করে।
তবে দুর্ঘটনার কারণ দেখিয়ে এসব রিকশা একেবারে বন্ধ করা আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন বুয়েটের এই শিক্ষক। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘২০০৯-২০১০ সাল থেকে এরা (ব্যাটারিচালিত রিকশা) নিয়ন্ত্রণহীনভাবে সড়কে নেমেছে। বাড়তে বাড়তে এদের সংখ্যা এখন অনেক বেশি হয়ে গেছে। বর্তমানে সঠিক সংখ্যা কেউই বলতে পারে না। সারাদেশে ব্যটারিচালিত রিকশার সংখ্যা কেউ বলেন ২০ লাখ, কেউবা দাবি করেন ৫০ লাখ। তাই এখন এর সঙ্গে বিশাল একটি জনগোষ্ঠির জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িয়ে গেছে। হুট করে এসব রিকশা বন্ধ করলে অনেকেই পথে বসে যেতে পারেন।’
তিনি বলেন, এছাড়া ব্যাটারিচালিত রিকশা বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে দেখা দিয়েছে যাত্রীদের কাছে। হুট করে এসব বন্ধ করলে যাতায়াতের জন্য বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে পারেন যাত্রীরা। এসব রিকশা বন্ধের সুযোগ নিয়ে অন্য পরিবহনগুলো ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারে। তাতে মানুষের যাতায়াত খরচ বাড়বে। সেজন্য আমি বলব ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ নয়, নিয়ন্ত্রণ খুবই জরুরি।’
হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বর্তমানে একটি অটোরিকশা তৈরি করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এর সঙ্গে আর ২০-২৫ হাজার টাকার বিনিয়োগ বাড়ালেই রিকশাগুলোকে নিরাপদ করা সম্ভব। এজন্য বিজ্ঞানভিত্তিক নকশা প্রণয়ন খুব জরুরি। অটোরিকশার দুর্বলতা দূর করে চলাচলের অনুমোদন দেয়া উচিত। এতে চাঁদাবাজিও বন্ধ হবে, সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে।’
তবে পুলিশ বলছে?
অটোরিকশা আটকানোর এই ফাঁদগুলো পরীক্ষামূলকভাবে বসানো হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ফাঁদগুলো একদিকে যেমন ফিডার রোড দিয়ে মেইন রোডে রিকশা উঠতে বাধা দেবে, অন্যদিকে ট্রাফিক পুলিশেরও প্রয়োজনও কমবে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগের উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘রিকশা আটকানোর এই ফাঁদগুলো পরীক্ষামূলক। এর নকশায় কোনো দুর্বলতা থাকলে সেগুলো চিহ্নিত করা হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী ফাঁদের নকশায় পরিবর্তন আনা হবে।’
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ