• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

জুলাই সনদে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ বাস্তবায়নে জটিলতা

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক    ১৮ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৪৯ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

জুলাই সনদের চুড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে। চলছে চুলছেড়া-বিশ্লেষণ। এতে নানা অসংগতিসহ অপূর্ণতা খুঁজে পেয়েছে বেশ কয়েকটি দল। নেতারা বলছেন- বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্টগুলো’ রয়েছে-তা কীভাবে সংবিধানে কার্যকর হবে উল্লেখ করা হয়নি। একইসঙ্গে অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোন সময়সীমাও নেই। কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা, আবার কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। অসংগতি চিহ্নিত করে তা সমাধানের পাশাপাশি সনদ দ্রুত বাস্তবায়ন চায় রাজনৈতিক দলগুলো। সেক্ষেত্রে নমনীয়তার কথাও বলছে কয়েকটি দল। জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা শেষে কাল-পরশুর মধ্যে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেবে দলগুলো। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশ নেয়া একাধিক দলের শীর্ষনেতারা জানিয়েছেন এমন তথ্য।    

তারা জানান, জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন এবং সংশ্লিষ্ট প্রস্তাবে অনেকগুলো বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। জুলাই সনদের সাংবিধানিক ও আইনি ভিত্তি নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না বলা হয়েছে। তবে বাস্তবায়নের কোনো পদ্ধতিতে হবে তা দলগুলোকে জানানো হয়নি। জাতীয় স্বার্থে সব দলগুলোকে ছাড় দেয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, অন্যস্থায় জুলাই সনদের অসামঞ্জস্যর সুযোগ নিয়ে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসতে পারে।  

এদিকে জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে আগামী ২০ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মতামত দেবে বিএনপি। আজ দলের দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এনিয়ে আলোচনা করবেন নেতারা। বৈঠকে কয়েকটি বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ নিয়েও পুর্ণবিবেচনার জন্য আলোচনা হবে। 

জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘জুলাই সনদের চূড়ান্ত খসড়ায় কিছু বিষয়ে অসামঞ্জস্যতা রয়েছে। পাশাপাশি কিছু বিষয় সঠিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। এগুলো আমাদের মতামতে তুলে ধরা হবে। সনদের চূড়ান্ত খসড়া পর্যালোচনা করে আগামী ২০ আগস্টের মধ্যে মতামত জানাবে বিএনপি।’

জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এএইচএম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, এটা তো এখন যেভাবে আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারিত হইছে। সেই জিনিসগুলো কোন ধরনের গ্যাপ আছে কিনা দেখতে হবে। অনেক সময় প্রিন্টিংয়েরও মিস্টেক (ছাপায়ও ভুল) হয়। ঐকমত্য কমিশনসহ সবাই মিলে কষ্ট পরিশ্রম করছে। অনেক সময় গেছে। এটার জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে একটা খসড়া তৈরি হইছে। এটা চূড়ান্ত হবে, চূড়ান্ত করার পরে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে আনা হবে। তারপরে বাস্তবায়ন করা হবে। এই ধাপগুলো এখনো অবশিষ্ট। সেগুলো না হলে তো, এটা লিখিত সনদ লাভ নাই। আইনি দলিল না হলে তো লাভ নাই। 

নাগরিক ঐক্যর সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘জুলাই সনদের আইনি বা বাস্তবায়ন নিয়েও নিজেদের মধ্যে আরও কথাবার্তা বলতে হবে। নোট অব ডিসেন্ট বিষয়গুলো নিয়ে পালামেন্টে আলোচনা হবে। আমার ধারণা, বিএনপির দেখতে চাইছে আগামী নির্বাচনে তারা কেমন ভোট পায়, তার ভিত্তিতে তারা সুযোগ দেবে। জাতীয় ঐকমত্য ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করার কথা বলেছিল প্রধান উপদেষ্টা। কিন্তু নোট অফ ডিসেন্ট থাকলে তো আর বাস্তবায়ন করতে পারবে না। এখনো সময় আছে। 

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, এটা কোনো ঐকমত্য সমাধান নয়। কারণ এখানে অনেক আর্দশের বিষয় হবে না। ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিয়ে কোনো ঐকমত্য হয় না। সুতরা ওই দল তো ক্ষমতায় গেলে তারা তা বাস্তবায়ন করবে না। সূতরাং এখানে ঐকমত্য হয়নি। দ্বিতীয়ত প্রথম পাঠানো খসড়া থেকে দ্বিতীয় দফায় খসড়ায় বাস্তবায়ন নিয়ে ভিন্ন কথা বলছে। ফলে বাস্তবায়ন নিয়ে আরও আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারন সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রশ্ন আছে, যেগুলো আমরা একমত হয়েছি। যেগুলোর সাথে সংবিধান সংশোধনটা যুক্ত না। সেগুলো তো সরকার অনেক আগেই কার্যকারী করতে পারে। বা এখনই সরকার এগুলোকে তারা কার্যকারী করতে পারেন। আর যেগুলো সংবিধান সংশোধনের সাথে যুক্ত, তার জন্য তো ইলেক্টেড পার্লামেন্ট লাগবে, ইলেক্ট রেপ্রেজেন্টেটিভ লাগবে। সেগুলো আমরা সেখানে আলোচনা করব। একটা আলোচনা হচ্ছে যে এটার একটা আইনি সুরক্ষা কিভাবে দেওয়া যায়। এই বিষয়ে সবাই যদি একমত হয়, তাহলে আমাদেরও সম্মতি থাকবে। আমরা আপত্তি করবো না। সব মিছিলে সোমবার (আজ) গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক ডাকা হয়েছে। 

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও দলীয় মুখপাত্র মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমাদের যে একটা মৌলিক দাবি ছিল, যেখানে আসলে সংকটের মূল জায়গা, নিম্ন কক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি- সেটা খসড়ায় উল্লেখ হয়নি। এজন্য আমরা মনে করছি যে, অন্য সংস্কারগুলো যা আছে, সব ঠিক আছে। কিন্তু এই মূল জায়গাটা (নির্বাচন পদ্ধতি) বাদ গেল, এটা নিয়ে আমাদের অনেক দলের দাবি ছিল। এটাকে আমরা একটা জুলাই সনদের অপূর্ণতা বলব। নির্বাচনে এটা নিয়ে সংকট থেকে যাবে। 

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, জুলাই জাতীয় সনদের চুড়ান্ত ড্রাফট আমরা পেয়েছি। আগে যে ড্রাফটটা আমরা পেয়েছিলাম তার আলোকে আমরা কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলাম, কিছুটা তার আলোকে পরিমার্জিত হয়েছে সেজন্য আমরা সন্তুষ্ট। এরপরও আমরা আমাদের চুড়ান্ত পর্যবেক্ষণ ও মতামত সহসা ঐকমত্য কমিশনকে অফিসিয়ালি জানাবো। সনদে মোট ৮৪ টি পয়েন্ট উল্লেখ করা হয়েছে, যেগুলোর কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিস্তারিত বিবরণও দেয়া আছে। সেখানে দল ও জোটগুলোর একমত এবং বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নোট অব ডিসেন্টগুলো কীভাবে সংবিধানে কার্যকর হবে, সেটা নিয়ে একটা ধোঁয়াশা থেকেই যাচ্ছে। সনদের অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের বিষয়ে এখনও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এক্ষেত্রে বিএনপি যদি একটু উদারতা ও আন্তরিকতা দেখায় আশাকরি একটা সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ঐকমত্য কমিশনে আমরা অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্য একমত-দ্বিমতটা প্রতিফলিত হয়নি। আমরা এসব ব্যাপার নিয়েও কথা বলব। সোমবার আমরা নিজেরা বসে কথা বলে একটা সিদ্ধান্ত নেব। সেখানে আমরা একমত এবং দ্বিমতের জায়গাটাকে আরো কমিয়ে আনা যায় কিনা, সেই ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নেব।  

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, শনিবার আমরা জুলাই সনদের খসড়া হাতে পেয়েছি। ১২ দলীয় জোট ২১ টি সংস্কার প্রস্তাবের মধ্যে ৯টি বিষয়ে নোট অফ দিসেন্ট দিয়েছে। সনদে ৬টি বিষয়ের ব্যাপারে ১২ দলীয় জোটের নোট অফ ডিসেন্ট এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। আমরা সংস্কার কমিশনের কাছে এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাবো।

এছাড়া অঙ্গীকারনামায় জুলাই সনদ বাস্তবায়নের কোন টাইম ফ্রেম বেধে দেওয়া হয়নি এবং জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আইনি ভিত্তি নিয়ে আমাদের মতামত কমিশনকে ২০ তারিখের মধ্যে জানাবো। এনিয়ে ১২ দলীয় জোটের মিটিং আহ্বান করা হয়েছে।

জুলাই সনদের সমন্বিত খসড়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোঃ শামছুল আলম বলেন, জুলাই সনদের ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দলগুলো একমত। কিন্তু এটা বাস্তবায়ন পরীক্ষা নিয়ে হয়তো, তাদের দুই-চারটা দলের মধ্যে হয়তো মতবিরোধ থাকতে পারে। কিন্তু তারপরেও আমি মনে করি যে, এটাকে সামনে রেখে সব রাজনৈতিক দলেই যেন ঐক্যমত পোষণ করে। তা নাহলে ফ্যাসিবাদী শক্তি ফিরে আসার সুযোগ পাবে। যদি ছাড় দিয়ে সমন্বিতভাবে যদি আমরা এগিয়ে যাই, তাহলে এটা একটা মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে। আগামী দিনে কোন শক্তি জনগণের বিরুদ্ধে আর কাজ করতে পারবে না। 

ভিওডি বাংলা/ এমপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
হিন্দুকুশ হিমালয় পার্লামেন্টারিয়ানস মিট -এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল
হিন্দুকুশ হিমালয় পার্লামেন্টারিয়ানস মিট -এ বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল
চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ ঘোষণা : ইসি সচিব
চলতি সপ্তাহেই নির্বাচনের চূড়ান্ত রোডম্যাপ ঘোষণা : ইসি সচিব
এজাহারভুক্ত সব পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে নোটিশ
এজাহারভুক্ত সব পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করতে নোটিশ