গণঅভ্যুত্থান, ৫ আগস্ট ও হাসিনার পতন


এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
দীর্ঘ শাসনে সবাইকে খেপিয়ে তুলেছিলেন শেখ হাসিনা। তাঁর সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দুর্নীতি, অর্থ পাচার, ও অর্থনীতির মন্দা পরিস্থিতিতে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আর রাজনৈতিক দিক থেকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের বাইরে অন্য সব দল সরকারবিরোধী অবস্থানে চলে যায়। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দিন ক্ষমতায় থাকা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টানা কয়েক সপ্তাহের ছাত্র ও জনতার বিক্ষোভ, রক্তক্ষয় এবং দেশজুড়ে অশান্তির পর প্রধানমন্ত্রীপদ এবং দেশ ছাড়তে বাধ্য হন।
ছাত্র-জনতা-মেহনতি মানুষের অভ্যুত্থানের মুখে ফলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এ বছর এক বছর পূর্ণ হলো। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকের স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয় এই দিন। ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক এ পট পরিবর্তনের দগদগে স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসলেও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ বাস্তবে কার্যত একটি ‘একনায়কতান্ত্রিক’ সরকারে পরিণত হয়েছিল। ২০০৮ সালের পর বাংলাদেশে বাস্তবিক অর্থে আর কোন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি। এই সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের দুইটি হয়েছে অনেকটা একতরফা নির্বাচন। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনটি হয়েছে একেবারেই আমি-তুমি-ডামি নির্বাচন। জনগনের ভোটারধিকারের কফিনে শেষ পেরেক মরা হয়েছিল। ফ্যাসীবাদের গত ১৫ বছরে মানুষ আসলে ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বেছে নেয়ার বা মতামত জানানোর কোন অধিকার পায়নি। দেওেশর বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ”আওয়ামী লীগ যেটা করেছে, জোরজবরদস্তি করে একটা কতৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা করলো। জনগণের কোন রায় তারা নেয়নি। ফলে জনগণের সমর্থনও ছিল না তাদের পেছনে। প্রশাসনকে ব্যবহার করে জবরদস্তি করে ভুয়া নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় ছিল।”
১৫ বছরে ফ্যাসীবাদী আওয়ামী সরকারের আমলে শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষই নয়, বিরোধী গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও বিরুদ্ধ মত দমন করা হয়েছে কঠোর হাতে। বিরোধী গণমাধ্যম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, দখল নেয়া হয়েছে অথবা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলাদেশে গত বহু বছর ধরে সামাজিক মাধ্যমেও শেখ হাসিনা বা শেখ মুজিব বিরোধী বক্তব্য পোস্ট করার জের ধরে মামলা হয়েছে, গ্রেফতার করা হয়েছে। এই দমনের জন্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট, সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টের মতো আইন করা হয়েছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, শেখ হাসিনার সরকার ও পুলিশ বাহিনী মিলে পুরো দেশকে একটা ‘মাফিয়া স্টেট’ তৈরি করেছিল। আর এসবের জন্য সবসময়েই সরকারি প্রশাসন যন্ত্র, পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা বাহিনী এমনকি বিচার বিভাগকে ব্যবহার করা হয়েছে।
১ আগষ্ট থেকে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন পর্যন্ত দেশবাসীরমত আমাকের থাকতে হয়েছিল দম বচন্ধ করা পরিস্থিতির মাঝে। নিজে একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে সরকারী বাহিনী ও সরকারী দলের সমর্থকদের হুমকির মুখে ছিলাম, ঠিক তেমনই একজন পিতা হিসাবেও সর্বক্ষন এক আতঙ্কের মাঝে প্রতিটি সময় পার করতে হয়েছে। জেষ্ট্য পুত্র গোলাম মোস্তকিন ভুইয়া মাহিন ও একমাত্র কণ্যা একমাত্র কণ্যা সুমাইয়া ভুইয়া মাহিমা দুইজনই ছাত্র অভ্যুত্থানের সাধারণ কর্মী হিসাবে মাঠে অবস্থান করছিল। তাদের সহকর্মী রাহুল, প্রিয়তাকে সাথে নিয়ে বন্ধুদের একটা গ্রুপ প্রতিনিয়ত রাজপথের আন্দোলনে সোচ্চার ছিল। রামপুরা থেকে বনশ্রীতে তখন চলছিল সরকারী বাহিনী ও সরকারী দলের সন্ত্রাসীদের গুলি বর্ষন। নির্বিচারে হামলা, ফলে আহত হচ্ছে আমার সন্তানের মত অন্যান্য সন্তানরাও। সে এক শাসরুদ্ধকর অবস্থা। একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে যোগাযোগ, সংবাদ কর্মীদের সাথে কথা বলা এরই মাঝে অন্য বাবা মার মত করে নিজ সন্তানদের জন্য চিন্তা করা। তখন পরিস্থিতিটা এমই ছিল নিজের সন্তানদেরও আন্দোলনে যেতে বাধাঁ দেয়ার মত নৈতিক অবস্থান ছিল না কোন বাবা-মারই। মাহিন-মাহিমার প্রশ্ন ছিল বাবা আমার ভাই-বোন, সহযোদ্ধারা মাঠে আমরা তো ঘরে থাকতে পারি না। অন্যদিকে আমাদের আরেক রাজনৈতিক সহকর্মী মিতা রহমানও ছিলেন একই ভাবে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায়। কারণ তার একমাত্র ছেলে মির্জা রাফিউ আহমেদও ঘর থেকে বের হয়ে আন্দোলনে।
৪ আগস্ট গভীর রাতে কথা হচ্ছিল বাংলাদেশ ন্যাপ চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানির সাথে। তিনি অনেকটা নিশ্চিভাবেই বললেন সরকারের পতন অসম্ভাবি। এই ফ্যাসীবাদী সরকার তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে পারবে না। তিনি করাবন্দি এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, সিনিয়র সহকারী সদস্য সচিব এবিএম খালিদ হোসেন, বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান এডভোকে সৈয়দ এহসানুল হুদা-সহ বিরোধী দলের নেতাদের খোজ খবর নেন। ৫ আগস্ট সকালেও সরকারের পেটোয়া বাহিনী আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষন ও হামলা অব্যাহত রাখে। এসময় খবর আসে আমার ছেলে ছড়রা গুলিতে আহত। খুব চিন্তিত হয়ে যখন চোখ দিয়ে অশ্রু বের হচ্ছে ঠিন তখনই খবর আসে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করছেন। আন্দোলণকারীদের সাথে সাধারণ মানুষের ঢেউয়ে রাজপথ যেন জনতার স্রোতে পরিনত হয়। সবার চোখে মুখে সে কি আনন্দ। আমার চোখের অশ্রু তখন আনন্দ নাকি বেদনার বুঝতে কষ্ট হচ্ছিল। হঠাৎ ছেলের কল মোবালে। "বাবা আমরা বিজয়ী হয়েছি" ফ্যাসীবাদী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করছে, পালিয়ে যাচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা ও গুলিতে শহিদ হয়েছেন আবু সাঈদ মুগ্ধ ওয়াসিমসহ বহু শিক্ষার্থী এবং নানা পেশার ১ হাজারেরও বেশি মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের তান্ডবে চোখের আলো নিভে গেছে ৪০০ জনের। মারাত্মক জখম ও আহত হয়েছেন ২৩ সহস্রাধিক মানুষ। পুঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে অনেককেই। এখনো শরীরে বুলেটের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন হাজারো মানুষ। এত ত্যাগের বিনিময়েই বিজয় এনে দিয়েছে আমাদের সন্তানরা।
ইতিহাসে লেখা হলো, ৫ আগস্ট ২০২৪, শেখ হাসিনার পতন। সাথে একটি নতুন বাংলাদেশের সূচনা। অনেকের জন্য এটা ছিল নতুন আশা, নতুন শুরু আর পুনর্গঠনের সুযোগ। তবে দিনটি একই সাথে অন্য কিছুরও সূচনা করেছিল - বিশৃঙ্খলা।
প্রতিটি সূচনার সাথে সাথে তার নিজস্ব একটি ঝড় আসে। অভ্যুত্থানে ছাত্র জনতার জয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে গেলেও হাসিনা ও তার পরিবার পিছিয়ে থাকতে রাজি হননি। পুরো শেখ পরিবার দেশ ছাড়লেও বারবার হয়েছেন সংবাদের শিরোনাম। দেশের বাইরে থেকেও তৈরি করেছেন বিশৃঙ্খলার ঘূর্ণিঝড়। রহস্যময় ফোন কল, উদ্ভট অভিযোগ, রাজনৈতিক নাটকীয়তা এবং ক্ষমতা পুনরুদ্ধারের মরিয়া চেষ্টা! কি ছিল না গত এক বছরে ?
শোনা যায়, দেশ ছাড়ার আগে জাতির উদ্দেশে বক্তব্য রেকর্ড করার অনুমতি চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা। কিন্তু, তাকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। এদিন দুপুর আড়াইটার দিকে গণভবন থেকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ‘নিরাপদ স্থানের উদ্দেশ্যে’ পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এ সময় সঙ্গে ছিলেন ছোটবোন শেখ রেহানা। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর ক্ষিপ্ত জনতা শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনে প্রবেশ করেন। পুরো গণভবনকে একটা ধ্বংসস্তুপে পরিনত করে। ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা, যিনি ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৬ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সোমবার (৫ আগস্ট) জনগণের রোষানলে পড়ে ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ভারতে আশ্রয় নেন। এই ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এক বিরল এবং অবিশ্বাস্য অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
একসময় শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিবুর রহমানও জনপ্রিয়তার শীর্ষে ছিলেন। আর সেখানে তিনি পৌঁছেছিলেন ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই। ইতিহাসে এ রকম দৃষ্টান্ত বিরল; কিন্তু দু:খ জনক হলেও সত্য যে, মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এমন পরিবর্তন হলো, যেটা অনেকেই ভাবতে পারেননি। শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তারএকবারেই শুণ্যের কোটায় চলে আসে। ঠিক একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলো পাঁচ দশক পরে—২০২৪ সালের ৫ আগস্ট। মোসাহেব ও মৌ-লোভীদের দ্বারা ঘেরা শেখ হাসিনা ভেবেছিলেন দিন এভাবেই যাবে; কিন্তু মানুষের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ কী ঘটিয়ে দিতে পারে, সেটা সম্ভবত ২৪ ঘণ্টা আগেও তিনি বুঝতে পারেননি।
শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ থেকে গণঅভ্যুত্থানে জুলাই মাসজুড়ে আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ তারিখে প্রবল জনরোষের মুখে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে ভারতের দিল্লিতে পালিয়ে যান । তার পতনের দিন ঢাকাসহ সারাদেশে লাখো মানুষ রাস্তায় নেমে আসে এবং আনন্দ প্রকাশ করে ।
শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে গেছেন। আওয়ামী লীগের নেতাদেরই কেউ কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে নিজের এত দিনের রাজনৈতিক অর্জন ধ্বংস করলেন। একই সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়া দল আওয়ামী লীগের অস্তিত্বকেও হুমকিতে ফেলেছেন। ৫ আগস্ট এটাই প্রমাণ করেছে যে কোনো স্বৈরাচারী শাসনই শেষ পর্যন্ত জনগণের ইচ্ছার কাছে পরাজিত হয়, হতে বাধ্য হয়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া এই আন্দোলন রূপ নেয় একটি পূর্ণাঙ্গ গণঅভ্যুত্থানে, যা দীর্ঘদিনের একটি স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায়। যদিও আন্দোলনের পথ রক্তাক্ত ছিল, তবুও এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনাকে নতুন করে জাগ্রত করেছে।
লেখক: রাজনীতিক কর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়]
সংস্কার ও বিচার ছাড়া নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে জুলাই গণঅভ্যুত্থান ব্যর্থ হবে
আশরাফুল আলম আশরাফ
দীঘ ১০ মাস হয়ে গেলো ঐক্যমত কমিশন …

দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি — কথা রেখেছেন মাহেরীন
জেট ফুয়েলের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে নিজের শরীর পুরোপুরি অঙ্গার হয়ে যাওয়ার …
