৭ নভেম্বরের আলোয় নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

এহ্সান মাহমুদ
ইতিহাস কীভাবে রচিত হয়? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘কাহিনি’ নাটকে এটির উত্তর খোঁজা যেতে পারে। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে রামের ওপর মহাকাব্য লিখতে বললেন। উত্তরে বাল্মীকি বললেন, তিনি রামের কীর্তিগান শুনেছেন, কিন্তু সকল ঘটনা জানেন না। সত্য ইতিবৃত্ত তিনি কীভাবে লিখবেন? বাল্মীকি মনে করেন, সত্য হতে বিচ্যুত হওয়ার ভয় আছে। বাল্মীকির এই সরল উক্তি শুনে দেবর্ষি নারদ বললেন, ‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি/ ঘটে যা তা সব সত্য নহে।’ অর্থাৎ নারদ বোঝাতে চাইলেন- বাল্মীকি যা লিখবেন, তা-ই হবে সত্য। যা ঘটে, তা সত্য নয়।
বাংলাদেশের ইতিহাস পাঠ করার আগে দেবর্ষি নারদের উক্তি জানা থাকলে ভালো। তাহলে ইতিহাস পাঠের বিড়ম্বনা থেকে রেহাই মিলতে পারে।
যখন কোনো কিছু নিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি হয়, তখন অনিবার্যভাবে তার পেছনেও থাকে আরেক ইতিহাস। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সে রকমই এক গৌরবময় ইতিহাস; ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরÑ - এই কালপরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং এর যে অভিযাত্রা তার সংগ্রামের ইতিহাস আসলেই বড় দীর্ঘ। পেছনে ফিরে তাকালে একে শুধু নভেম্বরের ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা যাবে না, বাংলাদেশের অভ্যুদয় পর্বের ইতিহাসের মধ্যে কিংবা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের নীতি, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে ওঠার লড়াইয়ের বীজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে এখানে।
আমরা স্মরণ করতে পারি, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বাধীন বাংলাদেশ ঘিরে অনিশ্চয়তা ঘনীভূত হয়। বাংলাদেশের নাগরিকের সামনে এমন কোনো দৃঢ় চিত্তের চরিত্র ছিল না, যার দিকে তাকিয়ে ভরসা পাওয়া যাবে। সেই সময় রাষ্ট্র পরিচালনায় ছিল না কারও একক কর্তৃত্ব। এর ফলে স্বাভাবিকভাবেই সৃষ্টি হয় নানা ধরনের সংকট। সেই সংকট রাষ্ট্র ও নাগরিক জীবনকে গভীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত করে। এরই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর হয়ে ৭ নভেম্বর সামনে চলে আসে। পরিবারের সদস্যবর্গসহ শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যা এবং তার শাসন অবসানের পর রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অনিশ্চয়তা তৈরি করে। যার ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হয়ে পড়ে নাবিকহীন এক জাহাজ। এসব অনিশ্চয়তা দূর করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে একটি নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে নিয়ে গিয়েছিল ৭ নভেম্বর। সেই সময়ে একজন দক্ষ নাবিক হিসেবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিকে গন্তব্যে পরিচালিত করেছিলেন জিয়াউর রহমান।
ইতিহাস রচনায় এখানে ৭ নভেম্বরকে যেভাবে চিত্রিত করা হয়েছে, তাতে পক্ষ-বিপক্ষ শক্তির শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ খুব একটা মনোযোগ পায়নি। একপক্ষের ইতিহাস রচনার মধ্যেই ছিল বিচিত্র সব উপাদান। সেই উপাদানগুলোকে ৭ নভেম্বরের ইতিহাস গবেষক হিসেবে যারা এখানে পরিচিতি পেয়েছেন তারা নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন বলা যাবে না। ৭ নভেম্বরের ইতিহাস ও তাৎপর্য যে কেবল আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাসেই সীমাবদ্ধ নয়, এটি যে এখানকার রাষ্ট্রপরিচালকদের সক্ষমতা ও দৃঢ়তার প্রমাণ সেটি অনুধাবনে সমর্থ হলেই ইতিহাস পাঠ সার্থক হবে।
৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে যে জিয়াউর রহমান সৈনিক থেকে জনতার হয়ে উঠলেন, তাঁর রাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতির একটি সামগ্রিক ছবি কেবল একটি দিনেই আঁকা যাবে না। তাঁকে দেখতে হবে সময়ের আলোকে। সে জন্য সেই উত্তাল সময়টিকে বোঝা দরকার। আলোচনা ও বিতর্কের আগেই একটি উপসংহার টেনে তারপর যুক্তিতর্ক সাজানোর যে প্রচলিত গবেষণাপদ্ধতি তা নিয়ে এগোলে জিয়াউর রহমানের ওপর সুবিচার করা যাবে না।
ইতিহাসকে বরাবরই আড়াল করার চেষ্টা আমাদের ভূখণ্ডে ছিল। ১৯৮২ সালে এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর সরকারি নথিপত্র ধ্বংস করার একটি আদেশ দিয়েছিলেন। সেই আমলে প্রচুর নথিপত্র পোড়ানো হয়েছিল। কী কী নথিপত্র পোড়ানো হয়েছিল, তা আমরা জানতে পারি না। এমন প্রশ্ন এখন তোলা যায় কিনাÑ সেই সময়ে কোন কোন নথি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল?
৭ নভেম্বর শেখ মুজিবের খুনি ফারুক-রশিদ-খন্দকার মোশতাক চক্রের বিরুদ্ধে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন খালেদ মোশাররফ। সেই সময়ে সেনাপ্রধান জিয়াকে গৃহবন্দি করা হয়। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনীর সিপাহিদের সহায়তায় জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ‘বিপ্লবের’ (রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল) প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভম্বরের প্রেক্ষাপটে বিদ্রোহী সিপাহিরা কয়েকজন অফিসারকে হত্যা করে জিয়াউর রহমানকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করেন। পরবর্তীকালে বিএনপি এই ঘটনাকে ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আবার কেউ কেউ ‘অফিসার হত্যা দিবস’ হিসেবে উদযাপন করেছে। তবে এ ঘটনার পরই যেটা হয়েছে, জিয়াউর রহমান একটি গন্তব্যহীন রাষ্ট্রের হাল ধরেন।
পঁচাত্তরের আগস্ট থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত দেশে অন্তত কুড়িটি ক্যু বা ক্যু চেষ্টা হয়েছে। জিয়াউর রহমান এসব ক্যু ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। পাশাপাশি যে রাষ্ট্রটি সদ্য স্বাধীনতা অর্জন করেছিলÑ অর্থনৈতিক কোনো ভিত্তি ছিল না, বিচার ও শৃঙ্খলা ছিল না, অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছিল, তিনি তার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পাশাপাশি স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় রীতি-নীতি, আইন-কানুন সংস্কারে হাত দেন। প্রকৃত অর্থে জিয়াউর রহমানের আমলেই দেশের সংবিধান, আইন, অর্থনীতি, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, রপ্তানি খাতে বহু বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কারের ধারণাটিও সেই সময়েই শুরু হয়েছিল।
৭ নভেম্বর ১৯৭৫-এর ৫০ বছর পর ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশে বসে যখন আমরা ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয়ের নানা অঙ্গীকারের কথা বলছি, সেই সময়ে ৭ নভেম্বরের মধ্য দিয়ে আলোক রেখা হিসেবে যে জিয়াউর রহমানকে পেয়েছিলাম, তাঁকে যেন ভুলে না যাই।
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের সময়
ভিওডি বাংলা/ এমএম

