এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রকৃত ফলাফল চিত্র


শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নিয়েও রাজনীতি করা যায় এমন এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃষ্টান্ত রেখে গেছে বিগত আওয়ামী শাসন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দমন-পীড়ন ও বিরোধীদের দমনে ব্যস্ত থাকা সেই সরকারের সময় শিক্ষাব্যবস্থাও পড়েছিল ভয়াবহ মেধাশূন্যতার মুখে। পাশের হার পর্যন্ত হয়ে উঠেছিল ‘রাজনৈতিক হাতিয়ার’।
আওয়ামী দুঃশাসনের বিপক্ষে ‘জুলাই আন্দোলনে’ ছাত্ররা একাট্টা হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। তারা ও তাদের শিক্ষানীতি দেশকে মেধাশূন্য করার হাতিয়ার ছিলো। যার প্রমাণ অতীতেই বার বার পেয়েছে জাতি।
প্রশ্ন জাগে সভ্য দেশে এমন হয়? বাস্তবতা বলছে, হয়েছে। ফলাফল বিশ্লেষণ বলছে, গত ১৫ বছর ধরে ‘পাশের হার’ এবং ‘জিপিএ-৫’র সংখ্যায় যেভাবে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে প্রকৃত শিক্ষার মানের পরিবর্তে উঠে এসেছে রাজনৈতিক স্বার্থ।
বিগত আওয়ামী শাসনামলে কিভাবে করা হয়েছিলো পাশের হারের রাজনীতি?: বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত প্রথম এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় পাশের হার এক লাফে প্রায় ১৩ শতাংশের বেশি বেড়ে যায়। সে বছর গড় পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৮০ শতাংশের ওপর পাশের হার দেখা যায়।
২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অধিকাংশ বছরেই গড় পাশের হার ছিল ৮০ শতাংশের বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—
২০১১ সালে পাশের হার দাঁড়ায় ৮২ দশমিক ১৬ শতাংশ, ২০১২ সালে ৮৬ দশমিক ৩৭ শতাংশ, ২০১৩ সালে ৮৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৪ সালে ৯১ দশমিক ৩৪ শতাংশ, ২০১৫ সালে ৮৭ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ, ২০১৬ সালে ৮৮ দশমিক ৭০ শতাংশ, ২০১৭ সালে ৮০ দশমিক ৩৫ শতাংশ, ২০১৮ সালে ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ, ২০১৯ সালে ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ, ২০২০ সালে ৮২ দশমিক ৮৭ শতাংশ, ২০২১ সালে ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ (করোনার বছরে অটোপাশ), ২০২২ সালে ৮৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ, ২০২৩ সালে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং ২০২৪ সালে পাশের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ।
অথচ ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সর্বমোট পাশের হার মাত্র ৬৮.৪৫ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় ১৪.৫৯ শতাংশ কম এবং বিগত ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ৯টি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত এসএসসি, মাদ্রাসা বোর্ডের দাখিল এবং কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের এসএসসি ও দাখিলসহ (ভোকেশনাল) ১১ বোর্ডের পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়। এতে সর্বমোট পাশের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ হার গত বছরের চেয়ে ১৪ দশমিক ৫৯ শতাংশ কম। এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় ভয়াবহ ফল বিপর্যয় হয়েছে, যা বিগত ১৫ বছরে সর্বনিম্ন।
শিক্ষা বোর্ড ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি অনুসরণ করা হয়েছে। অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরে নম্বর না দেওয়ার নির্দেশনা ছিল পরিষ্কার। এর ফলে, শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মেধার ভিত্তিতে ফল প্রকাশ পেয়েছে।
সব বোর্ডেই গণিতে খারাপ করার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাশের হারে। ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজিতেও খারাপ করেছে, তবে গণিতের মতো নয়। দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছে। অপরদিকে ইংরেজিতে ফেল করেছে ১৩ শতাংশ। দুই বিষয়েই ফেলের হার গত কয়েক বছরের চেয়ে বেশি। এছাড়া মানবিক বিভাগে ৪৬ শতাংশ এবং ব্যবসায় শিক্ষায় প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এসবের প্রভাব পড়েছে এবার সার্বিক ফলে।
দীর্ঘদিন ধরে চলা পাবলিক পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া বা পাশের হার বাড়ানো থেকে বেরিয়ে এসেছে সরকার। শিক্ষার্থীদের অপ্রাসঙ্গিক ও ভুল উত্তরে নম্বর না দেওয়া এবং যথাযথ মূল্যায়নের নির্দেশনা ছিল বোর্ড থেকে। এতে ফলাফলে প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
১৫ বছরের মধ্যেও এবারের পাশের হার সর্বনিম্ন। শুধু পাশই নয়, জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও কমেছে। এবার সর্বমোট ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। গত বছর পেয়েছিল ১ লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন। সেই হিসাবে জিপিএ-৫ কমেছে ৪৩ হাজার ৯৭টি। তবে এবারও ছাত্রীরা বেশ ভালো করেছে। ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীদের পাশের হার প্রায় ৪ শতাংশ বেশি। ছাত্রদের চেয়ে ৮ হাজার ২০০ বেশি ছাত্রী জিপিএ-৫ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেড় দশক ধরে খাতা মূল্যায়নে উদারনীতির কারণে দেশে পাশের হার এবং জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়লেও শিক্ষার মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন ছিল। ২০১০ সালে সৃজনশীল পদ্ধতি চালুর পর থেকে খাতা মূল্যায়নে উদার হওয়ার চর্চা ব্যাপকতা পায়। পরীক্ষকদের মৌখিকভাবে নির্দেশনা দেওয়া হয়, খাতায় কিছু লেখা থাকলেই যেন নম্বর দেওয়া হয়। এতে পাশের হার ও জিপিএ-৫-এর উল্লম্ফন ঘটে। শিক্ষার সার্বিক মান নিয়ে দেশ-বিদেশে প্রশ্ন ওঠে।
এ বিষয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার বলেছেন, এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফলাফলে শিক্ষার্থীদের মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন করা হয়েছে। ১৬ বছরে যে সরকার ছিল, তাদের আমলে সরকারের সাফল্য দেখানোর জন্য ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়ে জিপিএ-৫-এর সংখ্যা বাড়িয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ফল প্রকাশ করা হতো। এমনকি সে ফল প্রকাশ নিয়ে এক ধরনের ফটোসেশনের আয়োজন ছিল সরকারপ্রধানের। আমাদের অন্তর্বর্তী সরকার এটাকে বাহুল্য মনে করছে। এটা থেকে সরে এসে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতার প্রকৃত মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে।
শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে রেজাল্ট প্রকাশের কারণে অতীতে ছাত্রছাত্রীদের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ায় তাদের প্রতি অবিচার করা হয়েছে। পরীক্ষায় পাশের হার বাড়ানোর পাশাপাশি জিপিএ-৫-এর সংখ্যাও বেশি পরিমাণে দেখানো হয়েছে। আমরা এবার জিপিএ-৫ নয়, প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন করেছি। আগামী দিনেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
ফল বিশ্লেষণে পাশের হার কমে যাওয়ার পেছনে আরও দুটি কারণ চিহ্নিত করা গেছে। এর একটি হচ্ছে, মানবিক বিভাগে পাশের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ, যা গত বছরের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে পাশের হার মাত্র ৬৬ শতাংশ। অর্থাৎ মানবিকে প্রায় ৪৬ শতাংশ ও ব্যবসায় শিক্ষায় প্রায় ৩৪ শতাংশ শিক্ষার্থী ফেল করেছে। এ দুই বিভাগের ফল সার্বিক পাশের হারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে গ্রামাঞ্চলের শিক্ষার্থীদের তুলনামূলক খারাপ ফল। এবার সর্বমোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ ছাত্রছাত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের সর্বনিম্ন পাশের হার বরিশাল বোর্ডে, যা মাত্র ৫৬ শতাংশ। এর পরে রয়েছে ময়মনসিংহ বোর্ড, যেখানে পাশের হার মাত্র ৫৮ শতাংশ। ফেল করা এসব শিক্ষার্থীর বেশির ভাগই গ্রামের এবং সুবিধাবঞ্চিত অভিভাবকের সন্তান।
এ সময় আন্তঃশিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. খন্দোকার এহসানুল কবির বলেন, যে ফল প্রকাশিত হয়েছে সেটি প্রকৃত ও সত্য। শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের অতিরিক্ত নম্বর দেওয়া হয়নি। সামগ্রিকভাবে এবারের ফলে প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে। তিনি বলেন, আগে কী হয়েছে সেটি আমরা বলব না। আমাদের ওপর মহল থেকে কোনো ধরনের চাপ ছিল না। আমাদের বলা হয়েছে, রেজাল্ট যা হবে, সেটিই দিতে হবে। আমরাও পরীক্ষকদের এ অনুরোধ জানিয়েছি। তাদের যথার্থভাবে খাতা মূল্যায়ন করার জন্য বলা হয়েছে। কাজেই যা বাস্তব, যা সত্য সেই ফল বেরিয়ে এসেছে। সঠিক মূল্যায়ন করতে আমরা শিক্ষকদের বাধ্য করেছি।
বরিশাল বোর্ডে পাশের হার কমার বিষয়ে চেয়ারম্যান বলেন, বরিশাল অঞ্চলে খাল-বিলসহ প্রান্তিক এলাকা বেশি। তাই ওসব অঞ্চলের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা একটু কঠিন হয়।
এবার ১১টি বোর্ডের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে বরিশাল বোর্ড, যার পাশের হার মাত্র ৫৬.৩৮ শতাংশ। সবচেয়ে ভালো ফল রাজশাহী বোর্ড, পাশের হার ৭৭.৬৩ শতাংশ।
বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফল (পাশের হার ও জিপিএ-৫):
বোর্ড পাশের হার জিপিএ-৫
ঢাকা ৬৭.৫১% ৩৭,০৬৮
রাজশাহী ৭৭.৬৩% ২২,৩২৭
কুমিল্লা ৬৩.৬০% ৯,৯০২
যশোর ৭৩.৬৯% ১৫,৪১০
চট্টগ্রাম ৭২.০৭% ১১,৮৪৩
বরিশাল ৫৬.৩৮% ৩,১১৪
সিলেট ৬৮.৫৭% ৩,৬১৪
দিনাজপুর ৬৭.০৩% ১৫,০৬২
ময়মনসিংহ ৫৮.২২% ৬,৬৭৮
মাদ্রাসা বোর্ড: পাশের হার ৬৮.৯%, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯,০৬৬ জন
কারিগরি বোর্ড: পাশের হার ৭৩.৬৩%, জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪,৯৪৮ জন
যেসব বিষয়ে বেশি ফেল হয়েছে:
গণিত: ফেল করেছে প্রায় ২৩%
ইংরেজি: ফেল করেছে ১৩%
মানবিক বিভাগ: ফেল করেছে প্রায় ৪৬%
ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগ: ফেল করেছে প্রায় ৩৪%
জিপিএ-৫ কমেছে :
২০২৪ সালে: ১,৮২,১২৯ জন
২০২৫ সালে: ১,৩৯,০৩২ জন
কমেছে ৪৩,০৯৭ জন
মেয়েরা এগিয়ে:
পাশের হার: ছাত্রী ৭১.০৩%, ছাত্র ৬৫.৮৮%
জিপিএ-৫: ছাত্রী ৭৩,৬১৬ জন, ছাত্র ৬৫,৪১৬ জন
শতভাগ পাশ ও শূন্য ফলাফল:
শতভাগ পাশ করা প্রতিষ্ঠান: ৯৮৪টি
শূন্য পাশ: ১৩৪টি প্রতিষ্ঠান
মোট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ৩০,০৮৮টি
অতীতে ফলাফলে ‘উদারতা’র মাধ্যমে মেধার প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হলেও এবার শিক্ষা বোর্ডগুলো কঠোরভাবে বাস্তব মূল্যায়নের পথে হেঁটেছে। ফলে, মেধার প্রকৃত চিত্র উদ্ভাসিত হয়েছে। সামগ্রিকভাবে, এটিকে দেশের শিক্ষা খাতে একটি ইতিবাচক বাঁক বলা চলে।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচপি/ এমপি
এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাসের হার ৬৮.৪৫ শতাংশ
চলতি বছরের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) ও সমমান পরীক্ষার ফল …

শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশনে নতুন পরিপত্র
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রথম প্রবেশ পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগে পুলিশ ভেরিফিকেশনের …
