• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

মুন্সিগঞ্জে হারিয়ে যেতে বসেছে পাটি শিল্প

তাহমিদ লৌহজং (মুন্সিগঞ্জ) প্রতিনিধি    ১০ জুলাই ২০২৫, ০৭:২৯ পি.এম.
পাটি বুনছে । ছবি: সংগৃহিত

তাহমিদ লৌহজং (মুন্সিগঞ্জ) প্রতিনিধি

কালের আবর্তে মুন্সিগঞ্জে হারিয়ে যাচ্ছে লৌহজংয়ের পাটি শিল্প। পাটি শিল্প বাংলাদেশের লোকাচারে জীবন ঘনিষ্ঠ ও ঐতিহ্যবাহী মৌকিক উপাদান। এক সময় গ্রামের বাড়িতে অতিথিরা এলে প্রথমেই বসতে দেওয়া হতো পাটিতে। গৃহকর্তার বসার জন্যও ছিল বিশেষ ধরনের পাটি। বর্তমানে হিন্দুদের বিয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ শীতলপাটি। গরমকালে শীতলপাটির কদর একটু বেশিই। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের দুপুরে এই পাটি দেহ-মনে শীতলতা আনে। ও বেশ আগে দেখা যেত উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে পাটির নান্দনিক কারুকার্য। এখন হারিয়েছে তার জৌলুসাদ।

এখন শুধু বাপ দাদার ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার জন্যই এই শিল্পটিতে অনেকে রয়েছে।বর্তমানে লৌহজং উপজেলার ১৮ টি পরিবার পাটি শিল্পকে তাদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে আকড়ে ধরে রয়েছে।

নতুন বধূদের হাতের ছোঁয়ায় নানা নকশায় উপজেলার মেদিনী মন্ডল ইউনিয়নের কুমারভোগ, গ্রামে তৈরি করা হয় শীতল পাটি, পাটি, বড় চট, ছোট চট প্রভৃতি। রপ্তানি পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি না পেলেও শৌখিন ব্যবসায়ী, বেড়াতে আসা অতিথিদের মাধ্যমে শীতলপাটি যাচ্ছে কলকাতা, মধ্যপ্রাচ্য, ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশে।

অনেকে আবার নকশা করা শীতলপাটি দেয়ালে টাঙিয়ে রাখেন বসার ঘরের শোভা বাড়াতে।পাটি তৈরি শিল্পীরা নিজেদের স্বপ্নের পাশাপাশি গ্রামের অন্য নারীদের পাটি তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন।

সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাঘ-ফাল্গুন হচ্ছে পাটি বুনার উত্তম সময়। আর বৈশাখে সেই পাটির চাহিদা থাকে ব্যাপক।

ইংরেজি মাষের জুলাই থেকে আগষ্ঠ পর্যস্ত, চলে হাট বাজারে প্রচুর বেচাকিনা,বছরে ২-৩ বার সিলেট থেকে পাটির কাঁচামাল বর্ষজীবী উদ্ভিদ ‘মোতরা’ বা ‘পাইত্রা’ আসে। সারা বছরের জন্য পাটির কাচামাল পাইত্রা/মোতরা কিনে নেয়া হয়। সেখান থেকে প্রক্রিয়াজাত করে আনতে সময় লেগে যায় ২-৩ মাস।এছাড়া মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর, টঙ্গিবাড়ি, লৌহজং উপজেলাসহ সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরা, কুসুমপুর, চন্দনধূল, আবিরপাড়া গ্রাম ও সিরাজদিখানের হাট থেকে কিনে আনা হয়। গ্রাম থেকে ১ পোজা পাইত্রা/মোতরা ৫০-১০০ টাকা আর হাট থেকে ৩০০-৩৫০ টাকায় কেনা হয়।একটা পাটি বানাইতে ৩ পত্তন টাকা লাগে। পাইত্রা/মোতরা কেনা, বেতি বের করা ও পাটি বুনানোর জন্য। ১ পোজা পাইত্রা/মোতরাকে প্রক্রিয়াজাত করলে ৩ ভাগ হয়। যার মধ্যে ১ ভাগ বেতি যা পাটি তৈরিতে ব্যবহার হয়, ১ ভাগ আতি যা ধানের মোটা ও পানের বিড়া বাধার কাজে ব্যবহার করা হয় এবং ১ ভাগ জালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ১ পোজা পাইত্রা/মোতরা থেকে ২ কেজি ৫০০ গ্রাম আতি বের হয়। স্থানীয় হাটে ৫০ টাকা কেজি দরে ২৫০ টাক বিক্রি হয় এ আতি।১ পোজা পাইত্রা/মোতরা দিয়ে ১ টি পাটি হয়। ওই পাটিটি ৫০০-৫৫০ টাকা দরে বিক্রি হয়। পাটির সাইজ অনুযায়ি বুননি মজুরী হয়ে থাকে। ৩ হাত বাই ৪ হাত ৯০ টাকা, সাড়ে ৩ বাই সাড়ে ৪ হাত ১২০ টাকা ও ৪ হাত বাই ৫ হাত ১৪০ টাকা। মান অনুযায়ী প্রতিটি পাটি বুনতে ২-৬ দিন লেগে যায়। উন্নত মানের পাটিকে ডালার বলা হয়। এটি বুনতে ৯-১০ দিন লেগে যায়। ১ টি পাটিতে বুননি খরচ হয় ৬০০ টাকা। পাইকারি বাজারে এর মূল্য ২৫০০-৩০০০ টাকা। এজেলার পাটি বিক্রির অন্যতম বাজার টঙ্গিবাড়ি উপজেলার বেতকা ও আব্দুল্লাপুর। এ হাটে ঢাকা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, নারায়নগঞ্জ ও নরসিংদি থেকে পাইকাররা পাটি কিনতে আসে। এছাড়া স্থায়ীভাবে ও সিরাজদিখান বাজারেও বিক্রি করা হয়।

শীতল পাটির কারু পল্লী গুলোতে গিয়ে দেখা গেছে, তিন চার জন গ্রুপ করে রং-বেরংয়ের বেত দিয়ে তৈরি করছে বিভিন্ন রকমের ফুল করা পাটি। আবার কেউ অন্যদের নতুন পাটির জো তুলে দিচ্ছে। শৈল্পিক উপনায় এবং নির্মাণ কুশলতার কারণে দক্ষ ও সুনিপুণ একজন পাটিকর নারীর কদরও রয়েছে সর্বত্র।হাতের বুনা পাটির মধ্যে আড়াই থেকে ৩ হাত পাইকারি বাজারে ২৫০ টাকা, ৩-৪ হাত ৪০০ টাকা, ৪-৫ হাত ৫০০ টাকা এবং ৫-৬ হাত ৯০০-১২০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে।

সিরাজদিখান উপজেলার ভাটিম ভোগ গ্রামের পাটিকর অতুল দে (৬০) জানান, আমি ছোট থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমার ১ ছেলে ২ মেয়ে নিয়ে খুব একটা ভাল নেই। পশ্চিম রাজদিয়া গ্রামের মনিন্দ্র চন্দ্র দে বলেন, আমরা ৪ ভাইয়ের মধ্যে ৩ ভাইই এ কাজে জড়িত। বুঝ জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এ কাজ করে আসছি। আমাদের সংসার এ দিয়ে কোনভাবে চলছে। গ্রামের বিয়েতে পাটির খুব চাহিদা। বাড়িতে এসেই তারা নিয়ে যায়। সরকার আমাদের সহযোগিতা করলে আমাদের মতো লোকেরা এ শিল্পটাকে বাচিয়ে রাখতে পারবে।পশ্চিম রাজদিয়ার মায়ারাণী দে, ইতি, শোভা দে, অর্চনা দের মতো লৌহজংয়ের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ নারী রয়েছে যারা পাটি বিক্রি করে সংসারের বাড়তি খরচের যোগান দেন। তারা নিজেদের পাশাপাশি এলাকার বেকার অন্য নারীদেরও স্বাবলম্বী হবার স্বপ্ন দেখান পাটিশিল্পের বিকাশে বড় সমস্যা হলো অর্থনৈতিক সমস্যা। শীতলপাটি তৈরির জন্য পাটি শিল্পীদের সরকারি, বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কোন ঋণ দেয় না। সরকার শীতলপাটি রপ্তানির উদ্যোগ নিলে পাটি শিল্পীদের দিন ঘুরে যেত।

লৌহজং সহ এসব এলাকার অনেকগুলোতে বাড়িতে গত কয়েক দশকের এ -আয়োজন বিলুপ্ত হয়ে যা”েছ । আবার কোথাও টিকে থাকলেও তা টিম টিম করা জ্বলা প্রদীপের মতো জ্বলছে। পুরো বিক্রমপুরের লৌহজংয়ে মাত্র ১৮টি বাড়িতে চলমান রয়েছে সামনে এ শিল্পকে এগিয়ে নেয়ার লক্ষে কাজ করবে বলেন জানান, নেছার উদ্দনি উপজলো নির্বাহী অফিসার ও এক্সকিউিটভি ম্যাজিস্ট্রেট। 


রুবেল ইসলাম,

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
শেরপুরে বৃক্ষরোপণ বৃক্ষমেলার শুভ উদ্বোধন
শেরপুরে বৃক্ষরোপণ বৃক্ষমেলার শুভ উদ্বোধন
কালিহাতীর নারান্দিয়া ভুমি অফিসে ঘুষ ছাড়া মিলেনা খাজনা খারিজ
কালিহাতীর নারান্দিয়া ভুমি অফিসে ঘুষ ছাড়া মিলেনা খাজনা খারিজ
কোটি টাকার তেল আত্মসাতের অভিযোগ
কোটি টাকার তেল আত্মসাতের অভিযোগ