যেভাবে রাজপথের বিপ্লবী হয়ে ওঠেন ওসমান হাদি

ঢাকা–৮ আসনের রাজনীতিতে সাম্প্রতিক সময়ে যে নামটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে, তা হলো শরিফ ওসমান হাদি—যিনি সাধারণভাবে ওসমান হাদি নামেই পরিচিত।
ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের সব সময় ছিলেন প্রতিবাদ মুখর। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের তরুণ রাজনৈতিক কর্মী, বক্তা এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক–সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম ইনকিলাব মঞ্চ-এর মুখপাত্র। স্বল্প সময়ের মধ্যেই তিনি রাজপথ, ক্যাম্পাস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসেন।
ওসমান হাদির জন্ম ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলায় এক ধর্মভীরু মুসলিম পরিবারে। তার বাবা ছিলেন একজন মাদ্রাসা শিক্ষক ও স্থানীয় ইমাম। ছয় ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। শৈশব থেকেই পারিবারিক পরিবেশে ধর্মীয় শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও সামাজিক দায়বদ্ধতার চর্চা তার ব্যক্তিত্ব গঠনে ভূমিকা রাখে।
হাদির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার শুরু নলছিটির একটি মাদ্রাসায়। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সেখানে পড়াশোনার পর তিনি ঝালকাঠি এন এস কামিল মাদ্রাসায় ভর্তি হন এবং আলিম পরীক্ষা সম্পন্ন করেন।
পরে উচ্চশিক্ষার জন্য তিনি রাজধানী ঢাকায় এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তার রাজনৈতিক চিন্তা ও নেতৃত্বগুণ আরও বিকশিত হয়।
আন্দোলনের রাজনীতিতে উত্থান
২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল ওসমান হাদির রাজনৈতিক জীবনের মোড় ঘোরানো অধ্যায়। ওই সময় তিনি ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন এবং ঢাকার রামপুরা এলাকায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। তরুণদের সংগঠিত করা, মিছিল–সমাবেশে বক্তব্য দেওয়া এবং রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি তুলে ধরার মাধ্যমে তিনি দ্রুত পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন।
ইনকিলাব মঞ্চ: দর্শন ও লক্ষ্য
জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী ছাত্র–জনতার অভিজ্ঞতা ও দাবির ভিত্তিতে ওসমান হাদির নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ইনকিলাব মঞ্চ। সংগঠনটির ঘোষিত লক্ষ্য হলো—সব ধরনের আধিপত্যবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা। গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, ন্যায়বিচার ও রাজনৈতিক জবাবদিহিকে এই প্ল্যাটফর্মের মূল ভিত্তি হিসেবে তুলে ধরা হয়।
রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্য
ওসমান হাদি বিভিন্ন সময়ে সংবাদ সম্মেলন ও জনসভায় দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে পুরোনো ধারার রাজনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। বিএনপি প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন, জনগণকেন্দ্রিক রাজনীতি ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়। একই সঙ্গে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতার সমালোচনা করে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন।
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ আন্দোলন
২০২৫ সালে আওয়ামী লীগকে সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রদ্রোহী সংগঠন হিসেবে নিষিদ্ধ করার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে ওসমান হাদি ছিলেন অন্যতম আলোচিত তরুণ নেতা। “ন্যাশনাল অ্যান্টি–ফ্যাসিস্ট ইউনিটি” ব্যানারের অধীনে পরিচালিত এই আন্দোলনে ইনকিলাব মঞ্চ সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
ঢাকা–৮ আসনে প্রার্থিতা
২০২৫ সালের ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা–৮ আসন থেকে সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী হওয়ার ঘোষণা দেন ওসমান হাদি। মতিঝিল, শাহবাগ, রমনা, পল্টন ও শাহজাহানপুর নিয়ে গঠিত এই আসনে তিনি প্রচলিত রাজনীতির বাইরে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরাসরি মতবিনিময়, ‘চা–সিঙ্গারা’ আড্ডা এবং পথসভা আয়োজনের ঘোষণা দেন। তার এই ভিন্নধর্মী প্রচারণা গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দেয়।
হুমকি, হামলা ও মৃত্যু
আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে একাধিকবার প্রাণনাশের হুমকি পাওয়ার কথা আগেই জানিয়েছিলেন ওসমান হাদী। ১২ ডিসেম্বর ২০২৫, জুমার নামাজের পর রাজধানীর বিজয়নগরের বক্স কালভার্ট এলাকায় দুর্বৃত্তদের গুলিতে তিনি গুরুতর আহত হন। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নেওয়া হলেও ১৮ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন।
রাজনৈতিক উত্তরাধিকার
স্বল্প সময়ের রাজনৈতিক জীবনে ওসমান হাদি তরুণদের মধ্যে প্রতিবাদী রাজনীতির প্রতীক হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন।
তার মৃত্যু শুধু ঢাকা–৮ নয়, দেশের সামগ্রিক রাজনীতিতেও নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে—তরুণ নেতৃত্ব, আন্দোলনভিত্তিক রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে।
ভিওডি বাংলা/ এমএম



