২৩ আগস্ট ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী
উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতিক শফিকুল গানি স্বপন


এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া
জন্মগ্রহণ করলে মানুষকে মরতেই হবে, এটাই চিরন্তন সত্য। এই সথ্যকে অস্বীকার করা যায় না, করা সম্ভবও নয়। তবে, এর মাঝেও কিছু মানুষ আছেন যারা মরণের পরও অমর হয়ে থাকেন। ইতিহাস তার সময়ের প্রয়োজনে সেই মানুষটিকে স্মরণ করে, স্বরণ করতে হয়। তেমনই একজন দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী, উদার গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল নেতাই হচ্ছেন শফিকুল গানি স্বপন। দোষে-গুনেই মানুষ, মানুষের মাঝেই দোষ-গুনের সমাহার থাকবে। মহামানব ছাড়া কোন মানুষই বিতর্কের উর্দ্ধে থাকতে পারে না, থাকেও না। শফিকুল গানি স্বপনও বিতর্কের উর্দ্ধে নন।
বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী, গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনীতির ইতিহাসে এক ধ্রুবতারা নাম শফিকুল গানি স্বপন। তিনি ছিলেন আপাত মস্তক একজন ভদ্র, সব্যসাচী, বিনয়ী ও মেধাবী রাজনীতিবিদ। প্রতিহিংসার রাজনীতির যুগেও তিনি বিনয়ী রাজনীতির এক উজ্জল নক্ষত্র। রাজনীতিক জীবনে শফিকুল গানি স্বপন তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ছিলেন কঠোর সমালোচক, কিন্তু সমালোচনা করতেও তিনি এমন শব্ধ ব্যবহার করতেন না যা রাজনৈতিক পরিবেশকে কুলষিত করে। যা আজকের রাজনীতিতেই ক্রমেই কমে যাচ্ছে। তিনি জাতীয় ঐক্যের রাজনীতি করেছেন। তিনি কখনো তার রাজনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তিনি যে রাজনীতি বিশ্বাস করতে তাই প্রয়োগ করার চেষ্টা করতেন। আমরা যখন শুধুমাত্র ক্ষমতায় জন্য রাজনৈতিক বিশ্বাসকে পদদলীত করতে কুন্ঠিত হন নাই তিনি।
প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক চেতনার মেধাবী রাজনীতিক জননেতা শফিকুল গানি স্বপন ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রংপুর জেলার আজকের নীলফামারী জেলার সদরে এদেশের রাজনীতির এক উজ্জ্বলতম নক্ষত্র জাতীয় নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়ার ঔরষে জন্ম গ্রহন করেন। তার মা হচ্ছেন মরহুমা সাবেরা রহমান (ছবি)।
১৯৭৯ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর মশিউর রহমান যাদু মিয়া মৃত্যুবরণ করলে শফিকুল গানি স্বপন রাজনৈতিক দৃশ্যপটে সরাসরি আর্বিভূত হন। পিতার মৃত্যুতে শূন্য আসনের উপ-নির্বাচনে তিনি জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রংপুর সদর ও নীলফামারীর ডোমার-ডিমলা আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ের মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্ত পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ-এর চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সাংবাদিক হিসাবেও তিনি ছিলেন অত্যান্ত মেধাবী। বাংলা ও ইংরেজী ভাষার অসাধারন দখল থাকার কারনে তিনি বাংলা ও ইংরেজী সংবাদপত্রের জগতে সাপ্তাহিক বঙ্গব্যাপী ও ওইকলি ফ্রাইডে প্রকাশ করেছিলেন। যা অল্প সময়ে পাঠক প্রিয়তা পেয়েছিল। ক্রীড়াঙ্গনেও তিনি যথেষ্ঠ অবদান রেখেছেন। দেশের ঐতিহ্যবাহী ক্রীড়া সংগঠন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব-এর গর্ভনিং বডির চেয়ারম্যান হিসাবে দায়িত্ব পালন কালে ক্লাবকে সুসংগঠিত ও তাঁর ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে তিনি অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। শেষ মুহুর্তেও দেশপ্রেমিক শক্তির বিরুদ্ধে অব্যাহত ষড়যন্ত্র প্রতিরোধের আকাংখা নিয়ে পুঞ্জিভুত দুঃখকষ্ট নিয়েই ২০০৯ সালের ২৩ আগষ্ট আমাদের কাছ থেকে চিরবিদায় নিয়ে চলে যান তিনি।
শফিকুল গানি স্বপন নাজহাত গানি শবনমের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নাজহাত গনি বাংলাদেশ ন্যাপের উপদেষ্টা ছিলেন। তার স্ত্রী ২২ জুন ২০১২ সালে মৃত্যুবরন করেছেন। তাদের তিন সন্তান। জেষ্ঠ্যপুত্র জেবেল রহমান গানি, কণ্যা ফারিয়া গানি ও কনিষ্ঠ পুত্র ব্যারিষ্টার মশিউর রহমান গানি। জ্যেষ্ঠপুত্র জেবেল রহমান গানি বর্তমানে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ'র চেয়ারম্যান। কনিষ্ঠপুত্র ব্যারিস্টার মশিউর রহমান গানি একজন আইনজীবী ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য।
ক্ষমতার ইতিহাস বড় নির্মম। ক্ষমতায় পেলে মানুষ ভুলে যায় ইতিহাসের কথা। কাউকেই ভুলে গেলে চলবে না ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, ক্ষণস্থায়ী। বর্তমান রাজনৈতিক শূণ্যতা পূরণে শফিকুল গানি স্বপনের মত মেধাবী রাজনীতিকদের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হচ্ছে। মনে রাখতে হবে ছাত্র-জনতার এই অভ্যুত্থানের পর কর্তৃত্ববাদী দখলদারত্বের পুরনো রাজনীতিতে আর ফিরে যাওয়ার আর কোন সুযোগ নাই। সেই সুযোগ তৈরী হলে সকলকেই মাসুল দিতে হবে।
প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে শফিকুল গানি স্বপন ছিলেন আপসহীন। শফিকুল গানি স্বপন রাজনীতিকে ব্যবসা হিসেবে দেখেননি। মওলানা ভাসানীর আদর্শের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ন্যাপ পুনর্গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার মেধাবী রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রাম আগামীতেও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় নেতাকর্মীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। বহু সময় ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছে। জনগনের দাবি ও ভাষা বোঝে এমন একটি রাজনৈতিক শক্তি খুঁজছে সাধারণ মানুষ। দু:খজনক হলেও সত্য যে, শাসকগোষ্টি দেশ শাসন করতে চায় কিন্তু জনগনের ভাষা বুঝতে পারে না। ফলে তাদের পতন হয় নির্মমভাবে। সবাই ব্যাস্ত হয়ে থাকে ক্ষমতায় টিকে থাকতে, পরিনতি ভোগ করতে হয় নির্মম। যার ফলে জনগনের নেতা আজ খুজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে দারিয়েছে। এসময় একজন শফিকুল গানি স্বপনের মত নেতা বড্ডই প্রয়োজন ছিল।
সংগ্রামী রাজনীতিক শফিকুল গানি স্বপন। একজন সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, লেখক, সমাজচিন্তক গণতান্ত্রিক আন্দোলনের আলোকবর্তিকা ও দেশমাতৃকার বীর সেনানী। শোষণমুক্ত বাংলাদেশ প্রতিষ।ঠার সংগ্রামে তিনি বেচে থাকবেন। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী রাজনীতির এক উজ্জল নক্ষত্র শফিকুল গানি স্বপনের স্বপ্ন পথ দেখাবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। শোষণমুক্তির স্বপ্নের মধ্যে বেঁচে থাকবেন তিনি। তাঁর মতো দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিক খুবই কম। পরিচ্ছন্ন ও অসম্ভব ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন এ মানুষটি ছিলেন নির্লোভ ও সাহসী। স্পষ্ট বক্তা ছিলেন তিনি। আলোতে যা বলতেন, অন্ধকারে তা-ই বলতেন।
শফিকুল গানি স্বপন বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। এমন সত্য নির্মোহ, মনীষীদের মৃত্যু হয় না। ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধা।
লেখক: রাজনীতিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক
ভিওডি বাংলা/ এমপি
[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়]