যশোরের অমৃতবাজার পত্রিকা যেভাবে কলকাতায়


যশোর অভিভক্ত বাংলার প্রথম জেলা। প্রাচীনকাল থেকে ইতিহাস ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ জেলাটি। এখানে জন্মগ্রহণ করেছেন দেশ-বিদেশ খ্যাত শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি, গবেষক, সাধকসহ বিখ্যাত বিভিন্ন পেশার মানুষ। পূর্বকাল থেকেই এ জেলা থেকে প্রকাশ হয়েছে নানা পত্রপত্রিকা। যার মধ্যে অন্যতম ছিল অমৃতবাজার পত্রিকা। অমৃত বাজার ভারতীয় উপমহাদেশে একটি প্রাচীনতম পত্রিকা। পত্রিকাটি কলকাতা, কটক, রাঁচি এবং এলাহাবাদ থেকে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হতো।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার মাগুরা ইউনিয়নের কপোতাক্ষ নদের তীরে অমৃতবাজার গ্রামের উকিল হরিনারায়ণ ঘোষ ছিলেন এই গ্রামের অধিবাসী। তিনি পেশায় যশোর জেলা আদালতের উকিল। সে সময় ঘোষ পরিবার প্রচুর অর্থ সম্পাদের মালিক ছিলেন।
হরিনারায়ণ ঘোষের স্ত্রী অমৃতময়ী দেবীর নামে ওই গ্রামে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করে নাম রাখা হয় অমৃতবাজার। পরে বাজারের নামেই গ্রামটি পরিচিত হয়ে ওঠে।
হরিনারায়ণ ঘোষের তৃতীয় ছেলে শিশির কুমার ঘোষ এবং চতুর্থ ছেলে মতিলাল ঘোষ ১৮৬৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ''অমৃতবাজার'' নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।
নীলকরদের শোষণের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকদের পক্ষে লড়াইয়ের জন্য ঘোষ ভাইয়েরা এই পত্রিকা শুরু করেছিলেন।
শিশিরকুমার ঘোষ (১৮৪০-১৯১১) ছিলেন পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক এবং ছোট ভাই মতিলাল ঘোষ (১৮৪৭-১৯২২) ছিলেন যুগ্ম সম্পাদক। শিশির কুমার ঘোষের মৃত্যুর পর ১৯১১ সাল থেকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক মতিলাল ঘোষ। মতিলাল ঘোষের মৃত্যুর পর পত্রিকায় তাঁর সহকারী, ছোট ভাই গোলাপলাল ঘোষ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। কিন্তু ভগ্ন স্বাস্থ্যের কারণে তিনি অপারগ হলে ১৯২৮ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শিশির কুমার ঘোষের ছেলে তুষারকান্তি ঘোষ (১৮৯৮-১৯৯৪)। তিনি সুদীর্ঘ ৬৬ বছর (আমৃত্যু) অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
তথ্যে আরও জানা যায়, ৩২ টাকা দিয়ে কেনা পেটানো কাঠের মুদ্রণ যন্ত্রের সাহায্যে এই পত্রিকা ছাপা হয়েছিল। অমৃত বাজারে প্লেগ রোগের প্রকোপ দেখা দেওয়ার কারণে ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকা কলকাতার বৌবাজারে স্থানান্তরিত হয়। এখান থেকেই ইংরেজি এবং বাংলা দুই ভাষাতেই সংবাদ ও মতামত প্রকাশ করে এই পত্রিকা একটা দ্বিভাষিক সাপ্তাহিক হিসেবে চালু হয়। এবং ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ২৫ মার্চ পর্যন্ত এ পত্রিকাটি বৌবাজার থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর বাগবাজারে স্থানান্তরিত হয়। সরকার-বিরোধী মতামত এবং জনগণের মধ্যে বিপুল প্রভাবের ফলে এ পত্রিকাটি সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের ভাইসরয় লর্ড লিটন প্রধানত এবিপি-এর বিরুদ্ধেই ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে ১৪ মার্চ 'ভার্নাকুলার প্রেস অ্যাক্ট' প্রবর্তন করেছিলেন। কিন্তু শিশিরকুমার ঘোষ এই বাংলা পত্রিকাকে পরবর্তী ২১ মার্চ ইংরাজী সাপ্তাহিক পত্রিকায় পরিবর্তিত করেন।
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্রুয়ারি পত্রিকা একটা দৈনিক সংবাদপত্রে পরিণত হয়। ভারতীয় মালিকানার দৈনিক সংবাদপত্রের মধ্যে এটাই প্রথম অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা চালু করে।
এটা ভারতীয় সাংবাদিকতার বিবর্তন ও বিকাশে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল এবং ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রস্তুতের ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে রুশ কমিউনিস্ট বিপ্লবী ভ্লাদিমির লেনিনএবিপি-কে ভারতের সেরা জাতীয়তাবাদী সংবাদপত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন।
আজ থেকে ১৫৬ বছর আগের সংবাদপত্র প্রথম প্রকাশিত হওয়ার ১২৩ বছর পর ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে এর প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
যশোরের অমৃতবাজার গ্রামটি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। নেই শুধু শিশির কুমার ঘোষ ও তাঁর অমৃতবাজার পত্রিকা। হয়ত একদিন সময়ের বির্বতনে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে এ ইতিহাস।
ভিওডি বাংলা/ এমএইচ