• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

জামাত-এনসিপি কি সরকারি দল?

   ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৬:২১ পি.এম.
বিশেষ কলাম। গ্রাফিক্স: ভিওডি বাংলা

আব্দুল আজিজ

বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় এক অদ্ভুত ধাঁধার মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশের জনগণ। দলীয় পরিচয় এবং কার্যক্রমে অস্বচ্ছতা, রাষ্ট্রীয় সুবিধার দখল, এবং জনমানসকে বিভ্রান্ত করার কৌশলে আজ এমন এক প্রশ্ন সামনে এসেছে—জামাত-এনসিপি কি সরকারি দল?

এই প্রশ্নটি কেবল রাজনৈতিক আলোচনার বিষয় নয়, বরং এটি একটি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রূপ নিয়েছে। কারণ, একটি রাজনৈতিক দলের সরকারে না থেকেও যদি তারা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, রাষ্ট্রের প্রশাসনিক যন্ত্রকে নিজেদের প্রয়োজনে ব্যবহার করে, তাহলে সেখানে গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতার চরম অবক্ষয় ঘটছে।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি চাঞ্চল্যকর ছবি ভাইরাল হয়—জামাতের নেতাকর্মীরা রাষ্ট্রীয় ট্রেনে করে ঢাকাগামী কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছে। সাধারণত ট্রেন ব্যবহার করতে হলে গণপরিবহন হিসেবে সবার জন্য সমান অধিকার থাকে। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, একটি পুরো ট্রেন কামরা জামাতের জন্য নির্ধারিত করা হয়েছে, যেখানে দলের পতাকা ও স্লোগান চলমান।

এটা কীভাবে সম্ভব? একটি বিতর্কিত দল, যার অতীতে সন্ত্রাসী কার্যক্রমের অভিযোগ আছে, তারা কীভাবে এত সরাসরি রাষ্ট্রীয় সুবিধা পায়?

এই ঘটনার পেছনে নেপথ্যের শক্তি কারা? কে দিয়েছে এই অনুমতি? এক্ষেত্রে রেলওয়ের ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। যদি জামাত সরকারি দলের অংশ না হয়, তাহলে তারা কীভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদকে এমন সরলভাবে ব্যবহার করতে পারে? মোদ্দা কথা সরকারি দল হলেও কি এই সুযোগ ভোগ করতে পারবে রাজনৈতিক দল?

এখন আসা যাক এনসিপির কথায়। এই দলটি বর্তমানে সরাসরি ক্ষমতায় নেই, তথাপি তাদের নেতাকর্মীদের আচরণ, সুবিধা গ্রহণ, ও কর্মকাণ্ড দেখে মনে হয় যেন তারা সরকারের অঘোষিত অংশ।

নামমাত্র বিরোধী দলের মতো থাকলেও, এনসিপি নেতাকর্মীরা আজ সরকারি মঞ্চে বক্তৃতা দেয়, সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখে, এবং সরকারি প্রকল্পে নিজের নাম ফলাও করে প্রচার করে। এমনকি সম্প্রতি মাসউদ নামক এক কেন্দ্রীয় নেতা ঘোষণা দিয়েছেন—‘সরকার রাস্তাঘাট করছে না, আমরা করছি’।

প্রশ্ন ওঠে, আপনি কি স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর চেয়েও বড় কোনো কর্তৃপক্ষ? জনগণের করের টাকায় পরিচালিত প্রকল্পকে নিজের দলীয় কৃতিত্ব বলে চালানো শুধু বিভ্রান্তিকর নয়, বরং এটি এক ধরনের প্রতারণা।

এনসিপির পরিচিত নাম সারজিস আলম, যিনি একটি বেসরকারি দলের পরিচয়ে আলোচনায় এসেছেন, সম্প্রতি সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ব্যবহার করে এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে গেছেন—এই সংবাদ সামাজিক ও মূলধারার মিডিয়ায় শোরগোল তুলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, একজন দলীয় নেতা (সরকারের সদস্য নন) কীভাবে সেনাবাহিনীর মতো সংবেদনশীল একটি বাহিনীর লজিস্টিক সাপোর্ট পান? কোন অনুমতিতে? কোন আইনের আওতায়?

এটা যদি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা না হয়, তাহলে রাষ্ট্র যাকে চায়, তাকেই বিশেষ ব্যবস্থায় সেবা দিতে পারে—এমন বার্তা কি জনগণকে দেওয়া হচ্ছে?

সরকারি দলের সংজ্ঞা যদি হয়—“যারা ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে” তবে বাস্তবতার আয়নাতে দেখা যাচ্ছে, জামাত-এনসিপি মিলেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উপভোক্তা হয়ে উঠেছে। কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ তুলে ধরা যাক—
১. জেলা প্রশাসকের বাংলোয় এনসিপি নেতার দাপ্তরিক বৈঠক।
২. জেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তার মাধ্যমে এনসিপি নেতার উদ্যোগে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প।
৩. সরকারি ত্রাণ বিতরণে এনসিপি নেতার ছবি ও নাম সংযুক্ত।
৫. বেসরকারি টিভি চ্যানেলে সরকারি প্রচারণার মাঝে জামাতপন্থী নেতার বক্তব্য।

এগুলো কি কেবল কাকতালীয়? নাকি এগুলো ইঙ্গিত করে, এই দলগুলো ‘বাই প্র্যাকটিস’ সরকারি দলের সমান সুবিধা পাচ্ছে?

এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতা হান্নান মাসউদ একাধিকবার বলেন, “আমরা নদী ভাঙন রোধ করছি, রাস্তাঘাট বানাচ্ছি, স্কুল মেরামত করছি।” অথচ এসব প্রকল্প মূলত সরকার কর্তৃক বাস্তবায়িত, করদাতাদের অর্থে পরিচালিত এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ দ্বারা তদারক করা হয়।

তার বক্তব্যকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দলীয় প্রচারণায় সরকারি কাজকে নিজের বলে প্রচার করা হচ্ছে। এই কাজ জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে এবং প্রকৃত কর্তৃপক্ষের অবমূল্যায়ন ঘটায়।“জামাত এনসিপি সরকারে নেই, কিন্তু ট্রেন-হেলিকপ্টার ব্যবহার করছে!”

এই প্রশ্নগুলো নিতান্ত আবেগনির্ভর নয়, বরং রাষ্ট্রচিন্তার অংশ। আজ যদি জনগণের করের টাকায় পরিচালিত যেকোনো প্রকল্পে জামাত বা এনসিপি নামে সাইনবোর্ড উঠে, তবে সেটা সরকারের সুনামের অপব্যবহার নয় কি?

বিষয়গুলো একটি সাংবিধানিক প্রশ্নও তৈরি করছে। যখন কোনো রাজনৈতিক দল সরকারি পদে না থেকেও সরকারি দপ্তর ও সম্পদ ব্যবহার করে, তখন প্রশাসন ও সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে।

প্রশাসন কি এখন আর সরকারের নির্দেশে চলে, নাকি যেকোনো সুবিধাপ্রাপ্ত রাজনৈতিক শক্তির দখলে চলে গেছে?

যদি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্দিষ্ট দলের বাহিনীর মতো কাজ করে, যদি ট্রেন, হেলিকপ্টার, রাস্তাঘাট, প্রশাসন—সবকিছুই সুবিধাবান্ধব কিছু গোষ্ঠীর হয়ে যায়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে—রাষ্ট্র কি তাহলে জনগণের না হয়ে ‘দলগত মালিকানায়’ চলে গেছে?

জামাত ও এনসিপির এই অবস্থানকে অব্যাহতভাবে বিশ্লেষণ না করলে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, জবাবদিহিতা, এবং প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ভয়ংকর হুমকির মুখে পড়বে।

জনগণের মনে এখন একটি প্রশ্নই ঘুরছে—জামাত ও এনসিপি কি নতুন যুগের ছায়া সরকার?

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট

ভিওডি বাংলা/ডিআর

[নিবন্ধ, সাক্ষাৎকার, প্রতিক্রিয়া প্রভৃতিতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। ভিওডি বাংলা সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে নিবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে প্রকাশিত মত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির ব্যাখ্যা বা বিশ্লেষণ, তথ্য-উপাত্ত, রাজনৈতিক, আইনগতসহ যাবতীয় বিষয়ের দায়ভার লেখকের, ভিওডি বাংলা কর্তৃপক্ষের নয়]

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন
বাস্তবতার নিরিখে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন
তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্ব-দূরদৃষ্টি ও বাফুফের উন্নয়ন
তাবিথ আউয়ালের নেতৃত্ব-দূরদৃষ্টি ও বাফুফের উন্নয়ন
ইরানে ইসরাইলের হামলা : মুসলিম বিশ্বের টনক নড়বে কবে ?
ইরানে ইসরাইলের হামলা : মুসলিম বিশ্বের টনক নড়বে কবে ?