• ঢাকা বুধবার, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ৩ পৌষ ১৪৩১

শ্রম মন্ত্রণালয়

দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের পুরস্কার ও বিদেশ পলায়নের সুযোগ দিচ্ছেন সচিব

   ২৬ জুন ২০২৫, ০৪:০৮ পি.এম.
ছবি: সংগৃহীত

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক

শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের অধীন বহুল আলোচিত, চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ-আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তাদের শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কৃত করছেন খোদ সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, যিনি নিজে আওয়ামীপন্থি এবং ওই সময়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। আবার কাউকে বিদেশ পলায়ন এবং বিদেশে অর্থপাচারেরও সুযোগ করে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে সচিবের বিরুদ্ধে, যারা বিগত আওয়ামী লীগ আমলে শীর্ষ দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন।

সচিবের হাত দিয়ে পুরস্কৃত হওয়া এসব কর্মকর্তার মধ্যে অন্যতম হলেন শ্রম অধিদপ্তরের অধীন টঙ্গী, গাজীপুরস্থ শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনের পরিচালক মো. মিজানুর রহমান, শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক, সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের ভাতিজি জামাই মোহাম্মদ মেহরাব পাটোয়ারী প্রমুখ। 

বর্তমানে যিনি টঙ্গী, গাজীপুরস্থ শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনের পরিচালক পদে কর্মরত আছেন এই মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে খুলনায় থাকাকালে গুরুতর অসংখ্য দুর্নীতি-অপকর্মের তথ্যপ্রমাণ রয়েছে। যা নিয়ে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনেরই একাধিক তদন্ত চলছে। তাছাড়া তিনি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট কর্মকর্তা হিসেবেও পরিচিত। গত জুলাই আন্দোলনের সময় খুলনায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঠেকানোর কাজে নিয়োজিত ছিলেন বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতিসহ এসব কারণে হাসিনার সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে তাকে খুলনা থেকে টঙ্গী, গাজীপুরস্থ শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনে সংযুক্তিতে শাস্তিমূলক পদায়ন করা হয়েছিল। কিন্তু সচিব এ এইচ এম সফিকুজ্জামান পরবর্তীতে এই মিজানুর রহমানকে সংযুক্তির পরিবর্তে সরাসরি একই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক পদে প্রাইজ পোস্টিং দেন, যাকে সংশ্লিষ্টরা পদোন্নতি হিসেবেই আখ্যায়িত করছেন। গত ১০ এপ্রিল তাকে প্রাইজ পোস্টিং দেয়া হয়। সচিব নিজে উদ্যোগী হয়ে এটি করেন। যখন তাকে এই পদায়ন দেয়া হয় ওই সময় সুনির্দিষ্ট অভিযোগে মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে দুদকের তদন্ত চলছিল। 

আওয়ামী লীগ আমলে শ্রম অধিদপ্তরের খুলনা আঞ্চলিক কার্যালয়ের পরিচালক পদে থাকাকালে ব্যাপকহারে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন মিজানুর রহমান। আওয়ামী প্রভাবের কারণে তিনি এতটা বেপরোয়া ছিলেন যে, কোনো নিয়ম-নীতির ধার-ধারতেন না। ৫ আগস্টের পরে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে ৯ অক্টোবর তাকে খুলনার পরিচালক থেকে টঙ্গী গাজীপুরস্থ শিল্প সম্পর্ক শিক্ষায়তনে সংযুক্তিতে শাস্তিমূলক পদায়ন করা হয়। তখন সেখানে পরিচালক পদে ছিলেন মো. বেল্লাল  হোসেন শেখ। কিন্তু গত ১০ এপ্রিল সচিব সফিকুজ্জামান পরিচালক বিল্লাল হোসেনকে অন্যত্র বদলি করে দুর্নীতিবাজ মিজানুর রহমানকে সেই পদে বসার ব্যবস্থা করেন। অথচ, এর আগে গত ১৭ নভেম্বর মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুদক। তাকে একাধিকবার দুদকে তলবও করা হয়। ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ তারিখে ইস্যুকৃত দুদকের এক চিঠিতে বলা হয়, “মো: মিজানুর রহমান, পরিচালক, বিভাগীয় শ্রম দপ্তর, খুলনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন বেআইনী, বিধি বহির্ভূত এবং স্বেচ্ছাচারী কর্মকান্ড সংক্রান্ত অভিযোগ। সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বর্ণিত অভিযোগের বিষয়ে আপনার বক্তব্য শ্রবণ ও গ্রহণ করা একান্ত প্রয়োজন।”

চিঠিটি ইস্যু করেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক আইরিন আক্তার। ওই চিঠিতে তাকে ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ দুদকের উক্ত কর্মকর্তার সামনে হাজির হয়ে অভিযোগের বিষয়ে জবাব দিতে বলা হয়। এমনকি মিজানুর রহমানের জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম সনদ, পাসপোর্ট এর সত্যায়িত ফটোকপি, টিআইএন নম্বর, ব্যবসার ক্ষেত্রে ট্রেড লাইসেন্স ইত্যাদির সত্যায়িত ফটোকপিও জমা দিতে বলা হয়। অথচ এর পরেই ১০ এপ্রিল তাকে প্রাইজ পোস্টিংয়ের মাধ্যমে পুরস্কৃত করেন সচিব সফিকুজ্জামান। 

জানা গেছে, ১ জুন ২০২৪ খুলনা বিভাগীয় ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের ত্রি-বার্ষিক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত নির্বাচনে খুলনা বিভাগীয় শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমান তার মনোনীত প্রার্থীদের নির্বাচনে জয়ী করার লক্ষ্যে বর্তমান সভাপতি কাজী সরোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক আজাদ শেখ ওরফে আবুল কালাম আজাদের নিকট হইতে প্রায় ৬ কোটি টাকার একটি গোপন মিশন হাতে নেন। শ্রম আইন অনুযায়ী নির্বাচনে শ্রম অধিদপ্তরের ২ থেকে ৩ জন সদস্য ভোট কেন্দ্রে থাকবে। কিন্তু শ্রম পরিচালক ভোট কেন্দ্রে ১৫ থেকে ২০ জন সদস্য নিয়োগ করেন। ভোট গ্রহণের পূর্বেই ইউনিয়নের ১৫০০ থেকে ২০০০ আইডি কার্ড বিপুল অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নিজেদের হস্তগত করেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই নিজেদের মনোনীত লোক দিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের বিনা বাধায় জয়ী করার জন্য ৯টি বুথে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ভোট কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতিনিধিরা এর প্রতিবাদ করিলেও তাতে কাজ হয়নি। কারণ মিজানুর রহমানের মনোনীত প্রার্থীরা বিশেষ করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আওয়ামী লীগ সমর্থক ও সাবেক শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের মদদপুষ্ট লোক।

অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মো. আ. রহিম বকস (দুদু) ছিলেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল খুলনা মহানগরের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট। আর আমলটা ছিল আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমান নির্বাচন শেষে পরিকল্পিতভাবে একটি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে ভোট গণনা না করে সমস্ত ব্যালট বাক্স তার দপ্তরে নিয়ে যান এবং সব প্রার্থীদের পরদিন বেলা ১১ টায় তার দপ্তরে যেতে বলেন। কিন্তু শ্রম পরিচালক রাতেই তার অফিস স্টাফদের দিয়ে কাজী সরোয়ার ও আবুল কালাম আজাদের মনোনীত প্রার্থীদের ব্যলটে সীল মেরে পরাজিত প্রার্থীদের জয়ী ও জয়ী প্রার্থীদের পরাজিত ঘোষণা করেন। উল্লেখ্য, বর্তমান সভাপতি ও কোষাধক্ষের নামে শ্রম আদালতে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে অর্থ আত্মসাতের কারণে একটি মামলা চলমান আছে। তারপরও শ্রম পরিচালক আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেন।

অন্যদিকে আ. রহিম বকস (দুদু) এর নামে কোন মামলা না থাকলেও তাকে বিভিন্নভাবে হয়রানি করে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার অপকৌশলে লিপ্ত ছিলেন শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমান। কিন্তু দুদু শ্রম আদালতে মামলা করায় তাকে নির্বাচন থেকে বিরত রাখার অপকৌশল ব্যর্থ হয়। নির্বাচন কমিটিতে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ ছিল। শুধুমাত্র রহিম বকস অন্য রাজনৈতিক দলে যুক্ত থাকায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাকে মাস্টার প্ল্যান করে নির্বাচনে হারানো হয়েছে। আওয়ামী ফ্যাসিস্ট দুর্নীতিবাজ সেই শ্রম পরিচালক মিজানুর রহমানকেই সচিব সফিকুজ্জামান অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে প্রাইজ পোস্টিং দিলেন!

এছাড়া সাবেক প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ানের বহুল আলোচিত-দুর্নীতিবাজ ভাতিজি জামাই, মন্ত্রণালয়ের অধীন কেন্দ্রীয় তহবিলের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মেহরাব পাটওয়ারীকে সম্প্রতি দু’বছরের জন্য বিদেশে শিক্ষা ছুটিতে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছেন সচিব। গত ২৯ মে মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে প্রজ্ঞাপন জারি হয়েছে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মেহরাব পাটওয়ারী আগামী ৫ আগস্ট থেকে ২০২৭ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষা ছুটিতে থাকবেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেহরাব পাটওয়ারী যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারলে আর ফিরে আসবেন না। কারণ, তার নিয়োগই সম্পূর্ণ অবৈধ। মুন্নুজান সুফিয়ান প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে ভাই, ভাতিজি, ভাতিজি জামাইসহ মোট ১৪ জনকে অবৈধভাবে নিয়োগ দিয়েছেন। মেহরাব পাটোয়ারীসহ এই চক্রটি প্রতিমন্ত্রীর প্রভাব খাটিয়ে অনেক দুর্নীতি-অপকর্মে জড়িয়েছেন। যে কারণে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে মুন্নুজানের বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির মামলাও হয়েছে।

ভিওডি বাংলা/ এমএইচপি

  • দেশজুড়ে এর পাঠক প্রিয়
আরও পড়ুন
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ঈদুল আজহা
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ভাবনায় ঈদুল আজহা
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেট
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে তিন কর্মকর্তার সিন্ডিকেট
রাজপথই সমাধান দেখছে বিএনপি
রাজপথই সমাধান দেখছে বিএনপি